An exceptional renunciation

An exceptional renunciation

এক ব্যতিক্রমী সন্ন্যাস 
-----------------------
By Arindam sarkar 

সাল ১৯১৪। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য পটপরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায় বিশ্ববাসী আতঙ্কে প্রহর গুণছে। সময় কোথায় আধ্যাত্মিক অন্বেষণের? যাদের পেটের ভাতটুকু জোটে না, তারা বেদান্তদর্শন বুঝবে কি করে? আর যাদের জুটতো, তারা পরের গ্রাসটুকু কিভাবে অগণিত লালায়িত ভুখা মানুষের সর্বগ্রাসী নজর থেকে আড়াল করবে, সেটার হদিশ করতো।
ভারতের অধ্যাত্ম দর্শনের সবশ্রেষ্ঠ শাখাটির অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ আচার্য সেসময় এই খাস কলকাতার বুকেই নিজের দিব্য অপ্রকট লীলাপ্রকাশ করতে চলেছেন, এর হদিশ কেউ রেখেছিল কি? 

ভূতপূর্ব ম্যাজিস্ট্রেট, ভ্রাম্যমাণ চাকরির সুবাদে কখনো পূর্ববঙ্গ, কখনো পশ্চিমবঙ্গ, কখনো ওড়িশায় গেছেন; যেখানে গেছেন সেখানকারই কুপ্রথা, সামাজিক বুজরুকি আর ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন; প্রচার করেছেন শুদ্ধ সারস্বত জ্ঞানবাণী।

২৩শে জুন, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে এই মহাপুরুষ কলকাতায় "ভক্তিভবন" নামক নিজ বাসগৃহেই মর্ত্যদৃষ্টির অগোচর হন। তিনি শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। "শুদ্ধাভক্তিধারার ভগীরথ" রূপে তিনি গৌড়ীয়ার নবজাগরণের ইতিহাসে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। 

গলতার গদ্দীতে শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভুর বিপুল জনপ্রিয়তা লাভের সময়ই গৌড়ীয় বেদান্ত সম্প্রদায়ের আতশবাজিটি শেষবারের মত দীপ্তমান হয়ে জগৎসভায় গৌড়চন্দ্র গৌরচন্দ্রের মহিমা গায়ন করেছিল। তারপর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আচার্য আর গৌড়ীয় ব্যাসপরম্পরার সিংহাসনে বসে দিগ্বিজয়ীর শিরোপা ধারণ করেননি। শ্রীধাম বৃন্দাবনে এবং শ্রীধাম নবদ্বীপে মুষ্টিমেয় কিছু বিরক্ত ভজনানন্দী মহাত্মা নিভৃতে বার্ষভানবীর প্রেমময়ী সেবায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রাণপ্রদীপটুকু টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাও প্রাকৃতজনের জড়চক্ষুর অন্তরালেই। 
তাহলে কি, গৌড়দেশে গৌরহরি অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল? উত্তরে বলব, "না"। বাঙালি গৌরহরিকে ভালবাসতো, কিন্তু তাঁর নির্দেশ আর তাঁর মতবাদকে বিকৃত করে ফেলেছিল। এর পেছনে অনেক দুষ্টশক্তি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল :
ক) বৌদ্ধমদত পুষ্ট শাক্ত কৌলাচারী ও বামাচারী
খ) প্রচ্ছন্ন শাক্তরূপী স্মার্ত, 
গ) সহজিয়া , বাউল ইত্যাদি অপসম্প্রদায়
ঘ) জাতগোস্বামী আর ভন্ড ভেকধারী 
ঙ) নব্য আধুনিক মায়াবাদী গোষ্ঠী

এরা প্রত্যেকেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে সম্মান করতো। কেউ ভালবাসতো, কেউ ভগবানরূপে আবার কেউ মহাপুরুষরূপে দেখতো। শাক্ত তান্ত্রিকেরা মহাপ্রভুর সব তত্ত্ব ও লীলাকে টেনেটুনে তান্ত্রিকী ব্যাখ্যা দিত, সহজিয়ারা মহাপ্রভুকে তাদের মতোই পরনারীগামী বলে ব্যাখ্যা দিত, জাতি গোস্বামীরা মহাপ্রভুর ভাগবত সম্প্রদায়টিকে একপ্রকার নিজেদের অর্থ উপার্জনের পন্থারূপে বানিয়ে নিয়েছিল। নব্য মায়াবাদী ব্রাহ্মেরা আউল বাউল ইত্যাদি অপসম্প্রদায়কেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভেবে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করতো।
যে কয়েকজন বৈষ্ণব পণ্ডিত ছিলেন তাঁদের সংখ্যাও খুব কম ছিল আর প্রচারের অবস্থা ছিল ততোধিক খারাপ। মহাপ্রভুর প্রচারিত বেদান্তধর্ম সেসময় অপসিদ্ধান্তের মেঘের আড়ালে প্রায় অস্তমিত হয়ে পড়েছিলেন। 
যে প্রেমের অবারিত সমুদ্র শ্রীমন্মহাপ্রভু জগজ্জীবের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, তা অপসম্প্রদায়ের পাঁকে দুর্গন্ধময় ডোবার রূপ নিয়েছিলেন।একদা পূর্ণযৌবন বাংলার বৈষ্ণব ধর্ম অশীতিপর বৃদ্ধের মত ধুঁকছিলেন। 
নিশ্চয়ই এ দুরবস্থা দর্শন করে জগদীশ্বরী কৃপাময়ীর হৃদয় করুণার্দ্র হয়ে ওঠে। তাই নিজ সেবাপরা প্রেষ্ঠা মঞ্জরীগণকে একের পর এক প্রেরণ করে ক্ষীয়মান গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে নিজ পদাশ্রয়ে রক্ষা করলেন। আর কেনই বা করবেন না? যে সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত ব্রজেন্দ্রনন্দন, যে সম্প্রদায়ের সংকীর্তন আন্দোলনের সংরক্ষক শ্রীনৃসিংহমুরারী, যে সম্প্রদায়ের সূত্রভাষ্য স্বয়ং শ্রীশ্রীগোবিন্দদেব কর্তৃক রচিত, স্থাপিত, অনুমোদিত ও প্রচারিত; সে সম্প্রদায় তো গোবিন্দানন্দিনী শ্রীমতি রাধারাণীর নিজ সম্প্রদায়।
তো, এই ঘোর দুরবস্থার দিনে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেক আগাছা দূর করে সম্প্রদায়-সূর্যকে পুনরায় মেঘমুক্ত করেন। তিনি শ্রীমন্মহাপ্রভুর জন্মস্থান শ্রীমায়াপুর যোগপীঠ আবিষ্কার করেন। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত "দশমূলরস" গ্রন্থের ১২১৬ -১২১৯ তম পঙক্তিতে গ্রন্থকার বিপিনবিহারী গোস্বামী একথা লিখেছেন: 
" নবদ্বীপ মায়াপুর গৌরজন্মস্থান।
প্রকাশ করিলা ইঁহ করিয়া সন্ধান।।" 

শ্রীসুরধুনীর পশ্চিমতীরে কুলিয়ার বাহিরদ্বীপ রামচন্দ্রপুর বা কাঁকড়ার মাঠই "গৌরজন্মস্থান" বলে যারা চিৎকার করেন, তারা নিশ্চয়ই এই প্রমাণটির দ্বারা নিরস্ত হবেন। শ্রীগৌরগোবিন্দের ইচ্ছা হলে "শ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাব স্থান" সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবেন। 
যাইহোক, বহুজনহিতায় আচার্যের অবতরণ। এ সকল লোকমান্য আচার্যবৃন্দ সবসময়ই সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র, স্বয়ংকে বলিদান দিয়েও শুদ্ধ গৌরবাণী প্রচারে সমর্থ। তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় এই জড়জগত থেকে অপ্রকট হবার পূর্বেই ভাবীকালের মায়াহত জীবের কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তির পথ সুনিশ্চিত করতেই রেখে গেলেন তাঁর প্রিয়তম পুত্ররত্নটিকে। তিনিই হলেন শ্রীল বিমলাপ্রসাদ সিদ্ধান্ত সরস্বতী। পরবর্তীতে তিনিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় সংরক্ষক প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর। 

কলকাতায় শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অপ্রকট হবার সময় শ্রীসিদ্ধান্ত সরস্বতী ছিলেন শ্রীমায়াপুরে। যদিও টেলিগ্রামে তিনি আগেই ঠাকুর মহাশয়ের আসন্ন অপ্রকটলীলা প্রকাশের আগাম সংবাদ তিনি পান। তবুও ভরা জুনমাসের বর্ষায় ট্রেন বিলম্ব হবার কারণে ঠাকুর মহাশয়ের অপ্রকটের কিছু পরেই তিনি কলকাতায় পৌঁছান। ইতোমধ্যে ঠাকুরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে যায়। মাতা ভগবতী দেবী পুত্র বিমলাপ্রসাদকে বলেন, ঠাকুর মহাশয় অপ্রকট হবার পূর্বে বিমলাপ্রসাদকে প্রচুর কৃপাশীর্বাদ করে গেছেন এবং শুদ্ধাভক্তি প্রচারে বিমলাপ্রসাদের একনিষ্ঠতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।তিনি বিমলাপ্রসাদকে নির্দেশ দিয়েছেন : শ্রীমায়াপুরের সেবা এবং শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষার প্রচার করতে। 

চলে গেলেন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয়। বিমলাপ্রসাদের বয়স তখন চল্লিশ। এই ঘটনার অনতিকাল পরেই আরো একটি ঘটনা ঘটে, সেটি হল গুরুদেব শ্রীল গৌরকিশোর বাবাজির অন্তর্ধান। ১৯১৫ সালের ১৬ই নভেম্বর পরমহংস বাবাজি মহারাজ এই মর্ত্যভূমি ত্যাগ করে নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন। বহু প্রযত্ন করে ভন্ড সহজিয়াদের কবল থেকে শ্রীল বাবাজি মহারাজের পূতদেহ রক্ষা করে সিদ্ধান্ত সরস্বতী সমাধি নির্মাণ করেন। শ্রীগুরুবর্গের কৃপা হলে কোন একটি পৃথক প্রবন্ধে "গৌরবাবার সমাধি" নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইল। 
মাত্র ষোলমাসের ব্যবধানে পরপর দুই মহান আচার্যের অপ্রকটের পর শ্রীসিদ্ধান্ত সরস্বতী অত্যন্ত ব্যথিত হন। তখন তিনি ঠাকুর মহাশয়ের নির্দেশক্রমে "পীযূষ-বর্ষিণী বৃত্তি"র "অনুবৃত্তি" রচনা করছিলেন। এসময় তিনি হতোদ্যম অবস্থায় "অনুবৃত্তি" রচনা বন্ধ করে দেন। আহার-নিদ্রার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি তীব্র ভজনে নিমগ্ন হন। তাঁকে সত্যপ্রচারের পথে পাহাড় প্রমাণ বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, জগজ্জীব আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুন বৃত্তি চরিতার্থ করে মূল্যবান জীবন নষ্ট করে চলেছে। মুখে ঈশ্বরকে মান্য করলেও কাজে সেই ঈশ্বরের বিরোধিতা করে চলেছে। ধার্মিক রূপে বহুল পরিচিত মুখোশধারীরা জনগণকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি নিজেদের ও বঞ্চিত করে চলেছে। জগতে সবই আছে, কেবল শুদ্ধা কৃষ্ণভক্তিই নেই। এসময় তিনি আর লৌকিক জীবনে ফিরতে চান নি। 

ঠিক এসময় কিছু ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একদিন শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের একটি পৃষ্ঠা তাঁর সামনে উড়ে আসে, যেখানে শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীল সনাতন গোস্বামীকে নির্দেশ দিচ্ছেন : ভক্তিশাস্ত্র প্রণয়ন, লুপ্ততীর্থ পুনরুদ্ধার আর কৃষ্ণভক্তির প্রচার করতে। পরোক্ষে এটি ছিল শ্রীমন্মহাপ্রভুর তরফ থেকে সিদ্ধান্ত সরস্বতীর প্রতি নির্দেশ। কিন্তু সিদ্ধান্ত সরস্বতী সেসময় ভাবলেন, "আমি অর্থহীন, লোকবল হীন, বুদ্ধিহীন। কিভাবে এই জড়জাগতিক ভোগলিপ্সু মানুষের কাছে শ্রীমন্মহাপ্রভুর শুদ্ধাবাণী প্রচার করব?" 
ঠিক এমন সময় একদিন রাতে শ্রীযোগপীঠে একটি স্বপ্নবৎ অর্ধবাহ্যদশায় শ্রীসিদ্ধান্ত সরস্বতী দেখলেন, পূর্বদিক হতে শ্রীপঞ্চতত্ত্ব, বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীগণ, শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজি, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজি এবং গৌরপার্ষদবৃন্দ তাঁকে বলছেন, 
"সরস্বতী, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ ? তুমি শুদ্ধাভক্তি প্রচারের কাজ আরম্ভ কর। চরাচরব্যাপী গৌরবাণী প্রচার কর। গৌর নাম, গৌরধাম এবং গৌরকাম পূরণার্থে সেবাপ্রকাশ কর। প্রচণ্ড উৎসাহে ভক্তিসিদ্ধান্ত প্রচার কর। আমরা নিত্যকাল তোমার সাথে আছি, তোমাকে সাহায্য করতে। অগণিত মানুষের সমর্থন, অপরিমেয় সমৃদ্ধি, অবারিত জ্ঞান এইসব কিছু তোমার কর্মযজ্ঞে যুক্ত হবার অপেক্ষা করছে। যখন যা প্রয়োজন, তা সব আসবে। পৃথিবী জুড়ে মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করতে বীর পদক্ষেপে এগিয়ে এস। কোন পার্থিব বাধাই তোমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা সর্বদাই তোমার সাথে আছি।" 
পরদিন সকালে শ্রীসিদ্ধান্ত সরস্বতীর শ্রীমুখে হাসি দেখা গেল। তিনি নতুন উৎসাহে প্রচার আরম্ভ করলেন। শুরু হল একটি নতুন অধ্যায়। মায়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নবসেনাপতি অভিষিক্ত হলেন। 
সাল ১৯১৮, ২৭শে মার্চ, শ্রীগৌরজয়ন্তী পূর্ণিমার দিনের আগের গোটা দিনটি শ্রীহরিনাম সংকীর্তনে অতিবাহিত করে, শ্রীমস্তক বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে, সন্ন্যাস সংস্কার প্রদানে সক্ষম উপযুক্ত গুরুর অভাবে তিনি নিজ শ্রীগুরুদেব সিদ্ধ শ্রীল গৌরকিশোর বাবাজি মহারাজের শ্রীচিত্রপটের সম্মুখে ধ্যানস্থ হন এবং শ্রুতি-স্মৃতি শাস্ত্র বৈধ সন্ন্যাস আশ্রমের প্রতীক স্বরূপ কাষায় গৈরিক এবং ত্রিদণ্ড অঙ্গীকার করেন।








Arindam sarkar is a dedicated devotee of ISKCON and born in a gaudiya vashnav family serving gaudiya vaishnavism since childhood. He is an active preacher, and writer of gaudiya scripture.