দ্বিতীয় অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় অভিরাম।
জয় জয় নিত্যানন্দ গুণমণি নাম।।
জয় জয় গৌরভক্ত করি নিবেদন।
অভিরাম পদে মোর করাহ বন্দন।।
কাতর হইয়া বলি কর পরিত্রাণ।
মায়া জালে পড়ি মুই হইনু অজ্ঞান।।
দ্বাদশ বৎসর মোর হইল জনম।
বৃথা হইল ইবে যত মোর পরিশ্রম।।
দেখিতে শুনিতে দিন যায় ত' বহিয়া।
মন কভু নহে স্থির গর্ত্তে পড়ে গিয়া।।
পড়িয়া বিষ্ঠার কূপে ডাকি বারে বারে।
পতিত বলিয়া ঘৃণা না করিহ মোরে।
শিরে ধরি বন্দি আমি সবার চরণ।
কুটিনাটি পানে যেন নাহি যায় মন।।
ভবিষ্যদ্ বৈষ্ণবপদ করিয়ে স্মরণ।
সবে মিলি শুদ্ধ কর মোর দুষ্ট মন।।
বোবা হয়ে আছি আমি কহাও কথন।
যা বলাও বলি আমি করি নিবেদন।।
গিরি লঙ্ঘিবারে যেন চাহে পঙ্গুজন।
অন্ধকে দিলে চক্ষু দেখে তারাগণ।।
সেইমত সবে মিলি করহ আশ্বাস।
অভিরামলীলা কিছু করি যে প্রকাশ।।
।। গোপীগণের স্বরূপ ও গোপী প্রেমের মাহাত্ম্য।।
পুনর্ব্বার অভিরাম বলেন বচন।
শুনহ চৈতন্যপ্রিয় গোপীর লক্ষণ।।
ত্রৈলোক্য পৃথিবী ধন্যা বৃন্দাবনপুরী।
তত্রাপী গোপীকা ধন্যা দেখিতে মাধুরী।।
তথাপি রাধিকা বৃন্দা হয়েন উত্তম।
রমণীর শিরোমণি দেখি মনোরম।।
বৃন্দাবনে আসি মোরা যবে গোচারণে।
রাধিকা সহিত তাহা দেখে সখীগণে।।
গৃহকার্য্য করে যদি মন নহে স্থির।
কোন ছল করি আইসে যমুনার তীর।।
যমুনার জল যত করে ঝলমলে।
কৃষ্ণমূর্তি দেখে সব যমুনার জলে।।
তখন কদম্ব বৃক্ষে বসিয়া আছিলে।
সখাগণ না দেখিয়া হইল বিকলে।।
সখাগণ মিলি তথা বলেন সবাই।
কোথায় গেলেন তব প্রিয় যে কানাই।।
সব সখাগণে আমি বলিনু বচন।
গোচারণ কর তিঁহ আসিবে এখন।।
তা সবা সান্ত্বনা করি খুঁজি বনে বনে।
যমুনাতে আসি পুনঃ দেখি গোপীগণে।।
।। গোপীগণের বস্ত্রহরণ লীলা ও শ্রীদামের বৃন্দাদেবীর রূপে প্রকাশ।।
গোপীগণে দেখি তথা হইনু বিস্ময়।
কেমনে সুধাব ইহা ভাবি যে নির্ণয়।।
বিবস্ত্র হইয়া সেই রহে গোপীগণ।
কদম্ব বৃক্ষেতে বস্ত্র দেখি যে তখন।।
বুঝিলাম কৃষ্ণ আসি করেন চাতুরী।
কেমনে মিলিব তাহা এই বেশ ধরি।।
এই বেশ ধরি যদি করি যে গমন।
ডুবিয়া মরিবে সব শ্রীমতীরগণ।।
রহস্য লাগিয়া রহ অনুমানে দেখি।
চক্রবাকে আচ্ছাদিয়া কাঁদে সব সখী।।
দেখিয়া সবার দুঃখমনেতে যে ভাবি।
শক্তিতে করিব লীলা হইব বৃন্দাদেবী।।
বৃন্দাবতী হইয়া তথা মিলন করিলা।
বৃন্দাবতী দেখি রাধা হাসিতে লাগিলা।।
আইস আইস প্রাণ বৃন্দা করি নিবেদন।
আমা সবাকার আজি রাখহ জীবন।।
গাগরী লইয়া মোরা আইলাম জলে।
এমন কলঙ্ক হৈল ঘুষিবে সকলে।।
তটেতে রাখিয়া বস্ত্র জলেতে নাবিলা।
সবাকার বস্ত্র আসি কানাই হরিলা।।
জলে থাকি বস্ত্র কত মাগি বারে বার।
শুনিয়া না শুনে কৃষ্ণ করে অহঙ্কার।।
এত শুনি বৃন্দাবতী হাসিতে লাগিলা।
কিসের লাগিয়া কৃষ্ণ অপমান কৈলা।।
শ্রীমতী বলেন বৃন্দা দেখহ আপনি।
কুলের কামিনী মোরা নবীনা যৌবনী।।
স্বপনে না জানি বৃন্দা এত দুঃখ হবে।
বিলম্ব হইলা এত ঘরেতে ভর্ৎসিবে।।
এতক্ষণ হৈল কেন বলিবে এখনি।
মোর ঘরে দুষ্ট বড় হয় ননদিনী।।
পুনশ্চ তোমারে বৃন্দা করি যে বিনয়।
তুমি মোর প্রিয় যত অন্যে তত নয়।।
তোমায় আমায় এক শুনহ নিশ্চয়।
তোমার চরিত্র দেখি লোকেতে বিস্ময়।।
অগ্রেতে যাইয়া রাসে কর আরোহণ।
পশ্চাতে যাইব আমি আর গোপীগণ।।
মোরে লয়ে তুমি কৃষ্ণ করাও মিলনে।
তোমার আশ্রিত হয়ে রহে গোপীগণে।।
বৃন্দা কৃপা হৈলে হয় বৃন্দাবন প্রাপ্তি।
প্রেম সেবা প্রাপ্তি হয় সখি সঙ্গে স্থিতি।।
যখন কৃষ্ণের বাঞ্ছা যার প্রতি হয়।
আমি না বলিতে তারে ছলেতে মিলায়।।
আঁখি ঠেরে বলে সেই জানিয়া তখন।
তাম্বুল চাহেন রাধা করহ গমন।।
একে একে আসি সবে রাসে প্রবেশিলা।
সেবা করি সবাকার আনন্দ যে হৈলা।।
প্রধান দূতিকা তুমি শুন বৃন্দাবতী।
বস্ত্র আনিয়া দেহ করি যে কাকুতি।।
রাধার কাকুতি দেখি বৃন্দা ঠাকুরাণী।
আশ্বাস করিয়া তবে চলিলা আপনি।।
।। গোপীদের বস্ত্র প্রত্যার্পনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের কাছে বৃন্দাদেবীর দৌত্য ।।
শীঘ্রগতি গেল তিঁহ কদম্বের তলে।
বৃন্দাকে দেখিয়া কৃষ্ণ হাসে কুতূহলে।।
তখন বলেন বৃন্দা কি কার্য্য করিলে।
এত কেন গোপীগণে অপমান কৈলে।।
শুনিয়া তখন কৃষ্ণ বলেন বচন।
মোরে কেন গালি দেয় যত গোপীগণ।।
যখন আইলা সব গোপীগণ জলে।
বসিয়াছিলাম আমি কদম্বের তলে।।
আমারে দেখিয়া গোপী টিটকারী দিয়া।
বিনা দোষে গেল কেন বাঁশী যে লইয়া।।
তুমি ত আইলে বৃন্দা গোপীর বচনে।
মোর কেন অপমান কৈল গোপীগণে।।
সবার প্রধান বৃন্দা শুনহ বচনে।
বিচার করহ দেখি হারে কোন জনে।।
বিচার করিলে বৃন্দা হারি যদি আমি।
মাথায় করিয়া বস্ত্র দিব যে আপনি।।
তবে বৃন্দাবতী পুনঃ বলেন বচনে।
তোমারে হারায় হেন নাহি ত্রিভুবন।।
তোমারে বলি কৃষ্ণ শুনহ বচন।
হারিল তোমার কাছে যত গোপীগণ।।
অপরাধ ক্ষমা কর বলিহে তোমারে।
বস্ত্র আনি সবাকার দেহত আমারে।।
এতেক শুনিয়া কৃষ্ণ বলেন বচন।
বিচার করিলে দেখ হারে গোপীগণ।।
রাধিকার পাশে তুমি করহ গমন।
সবারে ডাকিলা কৃষ্ণ দিবেন বসন।।
।। বৃন্দাদেবীর মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ও গোপীগণের বিচার।।
এতেক শুনিয়া গেল রাধিকার পাশে।
বৃন্দাকে দেখিয়া রাধা ঠারে ঠারে হাসে।।
বৃন্দাবতী বলে রাধা কি বলিব আর।
কৃষ্ণকে বলিনু এই কেমন আচার।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন মোর আপনি আইলা।
দোষগুণ না জানিয়া আমারে ভর্ৎসিলা।।
বিচার করিনু তবে কড়ার করিয়া।
বিচারে হারিবে যেই বস্ত্র দিবে বইয়া।।
বিচার করিয়া তবে ভাবি মনে মনে।
গোপীর হইল হার বলিব কেমনে।।
কহিনু কত যে আমি কৃষ্ণে দাবাইয়া।
ঘাট হৈল কি করিবে সহজে তারা মেয়া।।
রাখাল হইয়া কেন ভয় না করিলে।
নবীন যুবতী সনে কেমনে মিলিলে।।
বুঝিনু সকল কৃষ্ণ তোমার চাতুরী।
বিবস্ত্র হইয়া গোপী জলে রহে পড়ি।।
কুলের কামিনী সব নবীনা যৌবনা।
কেহ যদি দেখে গোপী মরিবে এখনি।।
তখন আমারে কৃষ্ণ বলেন হাসিয়া।
বিনা দোষে হার নাহি দেখিলে বুঝিয়া।।
পুনশ্চ নাগর কৃষ্ণ বলে কুতূহলে।
সবাকার আন বৃন্দা কদম্বের মূলে।।
এসত্য বলি যে রাধা শুনহ বচন।
কেমনে যাইবে সবে নবীন যৌবন।।
যার পানে চায় সেই কালীয়া চঞ্চল।
সাপিনী দংশনে বিষ চড়িবে সকল।।
রাধিকা বলেন বৃন্দা কি হবে এখন।
কেমনে যাইব মোরা কদম্ব কানন।।
ভুবনে ঘুষিবে মোর হইবে অখ্যাতি।
রাজার নন্দিনী তাহে হই কুলবতী।।
শুনিয়া তখন বৃন্দা বলেন বচন।
শীঘ্রগতি চল সবে না কর গউন।।
বিলম্ব না কর রাধা বলি যে তোমারে।
যদি কেহ দেখে ইহা বলিবেক ঘরে।।
শুনিয়া শ্রীমতী পুনঃ বলেন বচন।
ছাড়িতে যমুনার জল নাহি যায় মন।।
উলঙ্গ হইয়া মোরা কেমনে যাইব।
পিরীতে ধিৎকার দিয়া জলেতে পশিব।।
শুনিয়া এতেক বৃন্দা বলেন তখন।
পিরীত করিয়া কেন ত্যাজিবে জীবন।।
আমার বচনে রাধা স্থির কর মন।
মরিলে না ছাড়ে দেখ পিরীতে রতন।।
জলেতে মরিলে কভু পিরীতি না যায়।
তুঁষের অনল যেন জ্বলিছে হিয়ায়।।
এমন পিরীতি সেই কহনে না যায়।
সাগরে ডুবিয়া থাক তবু না জুড়ায়।।
তাহার দৃষ্টান্ত কহি শুনহ সত্বর।
সাগর নিকটে এক থাকে তরুবর।।
লতা সব বেড়ি তাকে করে আরোহণ।
ভরেতে পড়িল বৃক্ষ সাগরে তখন।।
লতা বৃক্ষ দুঁহে মিলি বন্যায় ভাসিলা।
কাঠুরিয়াগণ তাহা আসিয়া ধরিলা।।
সেই তরু লইয়ি কাটে কাঠুরিয়াগণ।
খন্ড খন্ড করি সব করিলা বন্ধন।।
বোঝা বাঁধি পুনরায় ঘরে লইয়া যায়।
সেইসব লতা কাষ্ঠ আগুনে পোড়ায়।।
আগুনে পোড়ায়ে সব করেন দাহন।
তবু না ছাড়িল দাগ পিরীতি এমন।।
সেই অভিপ্রায় দেখি দুঁহার চরিত।
কেমনে ছাড়িতে চাও পিরীতি জড়িত।।
তোমারে বলি যে রাধা শুনহ বচন।
জল বিনে মীন যেন না বাঁচে কখন।।
কৃষ্ণ জল তুমি মীন বুঝ মনে মনে।।
তাহাকে ছাড়িতে চাহ কোন আচরণে।।
এতেক শুনিয়া রাধা বলেন তখন।
পিরীতি করিয়া বুঝি হারানু জীবন।।
কুলের কামিনী হয়ে পিরীতি করিনু।
অবলা অখলমতী অল্পে ভুলিনু।।
কদম্বের তলে সেই বাঁশী যে থুইলা।
প্রেমে অচেতন মোরা জলেতে পড়িলা।।
জলেতে পড়িয়া সবে হইনু বিকল।
বস্ত্র আসি হেনকালে হরিল সকল।।
বাঁশী দ্বারে অচেতন হইনু সবাই।
অতএব বস্ত্র সব হরিল কানাই।।
চেতন রহিত যদি না হত সবাকার।
ধরিয়া বঁধূকে বহু দিতাম ধিৎকার।।
এত অপমান বৃন্দা কে সহিতে পারে।
পিরীতি করিনু তাই অহঙ্কার করে।।
তোমারে বলিনু বৃন্দা শুনহ বচনে।
পিরীতি করিয়া মোরে দুঃখেতে ত্যাজিল।
সুজনে কুজনে দেখ কভু ভাল নয়।
আত্মসুখী হয়ে ভাঙ্গে পিরীতি নিশ্চয়।।
সুজনের কথা বলি শুন বৃন্দাবতী।
পরের দুঃখে দুঃখী হয় দিবারাতি।।
আপনি বিকায়া সেই করে উপকার।
মনেতে ভাবিয়া বৃন্দা করহ বিচার।।
শুনিয়া বিচার তবে কহ বৃন্দাবতী।
বিষয় জাতীয় সুখ কৃষ্ণের পিরীতি।।
নানা পুষ্পে মধু খায় ভ্রমরার রীত।
বুঝি নিশ্চয় আমি তাহার চরিত।।
তোমারে বলি যে রাধা শুনহ নির্ণয়।
আশ্রয় জাতীয় সুখ তোমার নিশ্চয়।।
পরের দুঃখেতে তুমি হও যে কাতর।
তোমারে না মানে যেই সেইত পামর।।
তোমার যে মনোবৃত্তি সব জানি আমি।
গোচারণে যখন যান নীলমণি।।
আট্টালিকা উপরি তুমি থাকহ বসিয়া।
তখন যান কৃষ্ণ মুরলী পূরিয়া।।
শুনিয়া মুরলী ধ্বনি হৈলে অচেতন।
তোমারে লইয়া কোলে করে গোপীগণ।।
কতক্ষণ পরে তবে পাইয়া চেতনে।
কোন পথে গেল কৃষ্ণ বল গোপীগণে।।
তখন তোমারে গোপী করেন উত্তর।
দেখিতে না পাই মোরা নন্দের কুমার।।
আপনি উঠিয়া তবে কর নিরীক্ষণ।
গোচারণ করে কৃষ্ণ লয়ে সখাগণ।।
দেখিয়া তখন হৈলে আনন্দিত মনে।
কহিতে লাগিলা দেখ যত গোপীগণে।।
বিধি না জানে ভাল করিতে সৃজন।
অতএব না হয় আর কৃষ্ণ দর্শন।।
কোটি নেত্র নাহি দিল আঁখি দিল দুই।
তাহাতে নিমিষ দিল কি দেখিব মুই।।
এতেক বিষাদ কৃষ্ণে কর কি লাগিয়া।
বুঝনে না যায় রাধা তোমার মহিমা।।
এতেক শুনিয়া রাধা বলেন বচন।
আর না জ্বালিহ সেই পিরীতি আগুন।।
সকল কহিলে বৃন্দা করি অনুমান।
অতএব হও তুমি দূতীর প্রধান।।
সবাই বলি যে মোরা শুনহ এখনে।
মো সবার দুঃখ যত কহ কৃষ্ণ স্থানে।।
কাতর দেখিয়া সেই বৃন্দা ঠাকুরাণী।
কহিতে আইলা কৃষ্ণে গোপী দুঃখ জানি।।
শীঘ্রগতি আসি তথা করে নিবেদন।
রাধিকার দুঃখে কৃষ্ণ মরে গোপীগণ।।
রাধিকা বলেন আমি কি কার্য্য করিনু।
পিরীতি করিয়া সব গোপীরে বধিনু।।
কি কার্য্য করিনু মুই পিরীতি করিয়া।
গোপীগণে মরে সব আমার লাগিয়া।।
তখন আমারে রাধা বলেন বচন।
কিসের লাগিয়া মরে যত গোপীগণ।।
কহ বৃন্দাবতী তুমি বিচার করিয়া।
সে সব বিচার কৃষ্ণ শুনহ আসিয়া।।
তখন রাধাকে আমি কহিনু নির্ণয়।
কেন বা মরয়ে গোপী শুনহ নিশ্চয়।।
ধনীর কাছেতে দেখ থাকে দুঃখীজন।
তার দুঃখ সুখ লয় করিয়া বন্টন।।
আপনার ধন দিয়া করেন পালন।
সর্বলোক ঘোষে তার মহৎ লক্ষণ।।
যশ কীর্ত্তি হয় তার শুনহ নিশ্চয়।
আপনা বিকায়া সেই উপকার করয়।।
সেইত বংশের লোক যদি দুঃখি হয়।
ভিক্ষা করি আনি তবু দুঃখীরে খাওয়ায়।।
এইমত গোপীগণ পর দুঃখ জানে।
আপনার দুঃখ সুখ কিছুই না মানে।।
আপনা বিকায়ে গোপী করে উপকার।
রাধিকার পাকে দুঃখ হইল সবার।।
রাধিকার দুঃখ সব লইবে বাঁটিয়া।
মরিবে সকল গোপী রাধিকা লাগিয়া।।
রাধিকা থাকুন সুখে আমরা মরিব।
মরিয়া রাধার দুঃখ সকল ভুঞ্জিব।।
গোপীর আশয় এই বিচারিয়া জানি।
তখন কহিনু শুন রাধা ঠাকুরাণী।।
দেখহ শরণাপন্ন হয় যে যাহার।
তাহারে না রাখে যেই অখ্যাতি তাহার।।
অযশ ঘুষয়ে তার সকল সংসারে।
আশ্রিত হইলে যদি না রাখে তাহারে।।
এতেক বলিয়া বৃন্দা পুনশ্চ কহিলা।
গোপীর বৃত্তান্ত এই সকল শুনিলা।।
তখন নাগর কৃষ্ণ বলেন বচন।
যত কিছু বল তুমি নাহি লয় মন।।
মিনতি করিয়া বলি শুন বৃন্দাবতী।
গোপীগণে আনি দেহ গিয়ে শীঘ্রগতি।।
বহুদিন হৈতে আমি মনে মনে করি।
বড় সাধ ছিল মোর বস্ত্র নিব হরি।।
বহু পূণ্য ফলে বিধি দিল সেই দিন।
মনবাঞ্ছা পূর্ণ হবে মিলালে এখন।।
আমার বচন পুনঃ শুন বৃন্দাবতী।
এখানে আনহ গোপী করিয়া কাকুতি।
আমার প্রধান দূতী বৃন্দা ঠাকুরাণী।
কৃষ্ণ প্রিয়গণ রসে সুপ্রিয়বাদিনী।।
তোমা বিনা প্রিয় মোর কেবা আছে আর।
গোপীর হইল মান ভাঙ্গ যে এবার।।
আপনার হস্তে আমি বস্ত্র পরাইব।
অপরাধ কৈনু বহু মিনতি করিব।।
আমার ওপরে রাধা করে অভিমান।
ভরসা করি যে মাত্র তাহার চরণ।।
রাধা মোর তন্ত্র মন্ত্র জপি তাঁর নাম।
রাধিকা বিমুখ হইলে ত্যাজিব পরাণ।।
প্রাণের অধিক মোর রাধা ঠাকুরাণী।
শীঘ্রগতি আন বৃন্দা কহি প্রিয়বাণী।।
।। বৃন্দাদেবী কে শ্রীকৃষ্ণের পুনর্বার দূতী রূপে প্রেরণ ও গোপীদের মান ভঞ্জন।।
এতেক শুনিয়া বৃন্দা গমন করিলা।
পথেতে আসিয়া পুনঃ উপায় সৃজিলা।।
কৃষ্ণের দূতিকা হয়ে রাধাকে মিলাব।
কৃষ্ণের বিরহ সব রাধাকে কহিব।।
উভয় সম্বন্ধে হৈল মিলন করিতে।
গোপীরে মিলিয়া বৃন্দা লাগিলা ভাবিতে।।
হেঁটমুখ হয়ে পুনঃ বসিলা তখন।
দেখিয়া রাধিকা জীউ বলেন বচন।।
হেঁট মুন্ড হয়ে বৃন্দা ভাব কি লাগিয়া।
কৃষ্ণের আশয় কিবা কহত আসিয়া।।
শুনিয়া তখন বৃন্দা বলেন বচনে।
সবার সমান দশা বলিব কেমনে।।
তোমার দুঃখের কথা তাহাকে কহিলা।
শুনিয়া তখন কৃষ্ণ ভূমিতে পড়িলা।।
বৃক্ষের উপর হৈতে পড়িলা যখন।
তখন তাহার রাধা না ছিল জীবন।।
তাহার কাকুতি দেখি করিলাম কোলে।
তোমার ভ্রমে রাধা ধরে মোর গলে।।
বসনে বাতাস করি করাই চেতন।
দুঁহেতে সমান দেখি ভাবি তাই এখন।।
এতেক শুনিয়া রাধা বলেনবচন।
মোরে দুঃখ দিয়া কৃষ্ণ হৈল অচেতন।।
দুঃখ নহে তবে মোরা সুখ করি মানি।
বিলম্ব না কর আর মিলিব এখনি।।
।। গোপীগণের শ্রীকৃষ্ণের বিরহ কাতরতা শ্রবণে মান ভঞ্জন ও শ্রীকৃষ্ণের কাছে গমন।।
পুনশ্চ বলি যে বৃন্দা শুনহ নির্ণয়।
সবার মধ্যেতে যাব কহিনু নিশ্চয়।।
জল হৈতে গোপীগণ তটেতে উঠিলা।
সবার মধ্যেতে রাধা প্রবেশ করিলা।।
মধ্যেতে থাকিয়া পুনঃ বলেন বচন।
চৌদিক হইয়া সবে করহ গমন।।
আর এক নিবেদন শুন বৃন্দাবতী।
সবার প্রধান তুমি করি যে কাকুতি।।
যখন মিলিব মোরা কদম্ব কাননে।
কৃষ্ণ ঠাঁই বস্ত্র মাগি দিবেন আপনে।।
যাইয়া রহিব মোরা হেঁট মুখ হইয়া।
কোন লাজে বস্ত্র সব মাগিব যাইয়া।।
শ্রীকৃষ্ণ করেন যদি কথোপকথন।
সে সব উত্তর বৃন্দা করিবে আপন।।
কাতর দেখিয়া বৃন্দা বলেন বচন।
আমা হৈতে যত হয় করিব তখন।।
কহিতে কহিতে গেল কদম্ব কাননে।
বসিয়া রহিলা গোপী হেঁট যে বদনে।।
।। শ্রীকৃষ্ণের গোপীগণের সাথে রঙ্গ পরিহাস ।।
তখন নাগর কৃষ্ণ কহিতে লাগিলা।
হেঁট মুন্ড হয়ে কেন গোপীরা বসিলা।।
সাক্ষাতে করে মান কিসের লাগিয়া।
তখনে বলেন বৃন্দা নাগরে হাসিয়া।।
তুমিত নাগর কৃষ্ণ হইলে আকুল।
বস্ত্রের লাগিয়া সব গোপিকা ব্যাকুল।।
শুনিয়া নাগর কৃষ্ণ বলেন বচন।
গোপী না চাহিলে মোরে না দিব বসন।।
উর্দ্ধমুখ হৈয়া গোপী চাহ মোর পানে।
তবে যে দিব আমি সবার বসনে।।
এত শুনি গোপীগণ কৃষ্ণপানে চায়।
তখন নাগর বস্ত্র গোপীরে দেখায়।।
এই বস্ত্র লহ সবে শুনহ বচন।
উর্দ্ধ হস্ত বিনু বস্ত্র না দিব এখন।।
এতেক শুনিয়া গোপী নয়ন মুদিয়া।
উর্দ্ধ হস্ত করি বস্ত্র মাগিতে লাগিলা।।
তখন নাগর কৃষ্ণ বলেন হাসিয়া।
নয়ন মুদিত গোপী কিসের লাগিয়া।।
নয়ন মিলিত সবে করহ এখন।
তবে সে দিব আমি সবার বসন।।
এতেক শুনিয়া গোপী কাঁদিয়া কহিলা।
বস্ত্র যে হরিয়া কৃষ্ণ অধীন করিলা।।
এমন অধীন হইয়া রব কতকাল।
আর না করিব মোরা পিরীতি জঞ্জাল।।
হেনকালে বৃন্দাবতী বলেন বচন।
শুনহ নাগর কৃষ্ণ করি নিবেদন।।
গোপীকার মনোবৃত্তি দেখহ বিচারি।
বস্ত্র দেহ ওহে কৃষ্ণ না কর চাতুরী।।
বৃন্দার বচনে কৃষ্ণ দিলেন বসন।
বস্ত্রপরি সবাকার আনন্দিত মন।।
তবে রাধাকৃষ্ণ সহ মিলন করিলা।
পুনশ্চ গোপীকা সব বৃন্দাকে কহিলা।।
যমুনার জলে বৃন্দা রহিল গাগরী।
কৃষ্ণবাঞ্ছা পূর্ণ হৈল যাই ত্বরা করি।।
কৃষ্ণ প্রণমিয়া গোপী করিলা গমন।
রমণীর শ্রেষ্ঠা বৃন্দা করান মিলন।।
জয় জয় বৃন্দাজীউ লইনু স্মরণ।
মোর মুখে বক্তা হয়ে কহাও কথন।।
তোমা অনুগত এই হয়েছে পামরে।
তোমা বিনা কেবা আছে এ তিন সংসারে।।
পুনরপি গেলা বৃন্দা গোপীকা লইয়া।
গমন করিলা গৃহে গাগরী ভরিয়া।।
।।
নিজ নিজ গৃহে সবে গেলেন তখন।
বৃন্দাকে তখন রাধা বলেন বচন।।
শুন শুন বৃন্দাবতী হইয়া উল্লাস।
আমার সঙ্গেতে চল আমার আবাস।।
ঘরে গুরুজন মোর বড়ই বিষম।
বিলম্ব হইল বলি করিবে গর্জ্জন।।
এতেক শুনিয়া বৃন্দা রাধিকা লইয়া।
গমন করেন গৃহে তখন যাইয়া।।
দেখিয়া জটিলা তারে দিলা আসন।
আইস আইস বলে করিয়া যতন।।
কোথা হইতে আইলা তুমি কহত নিশ্চয়।
বহু পূণ্যফলে আজি হইলে উদয়।।
শুনিয়া তখন বৃন্দা কহিতে লাগিলা।
তোমাকে দেখিতে আজি এখানে আইলা।।
দুঃস্বপ্ন দেখিয়া তোমা মনে মোর ভ্রম।
বলিয়া যাইব তার যত আছে ক্রম।।
অপূর্ব সামগ্রী আজি করিবে আহার।
পিঠা পানা আদি করি অনেক প্রকার।।
উদর পূর্ণিত করি আজি যে যাইবে।
দুঃস্বপ্ন তোমাকে কিছু করিতে নারিবে।।
শুনিয়া জটিলা বহু করে নতি স্তুতি।
আজি মোর গৃহে তুমি রহ বৃন্দাবতী।।
তখন বলিলেন বৃন্দা করিয়া বিনয়।
থাকিতে না পাব আমি কহি যে নিশ্চয়।।
এত বলি বৃন্দাবতী গমন করিলা।
হেনকালে মহাপ্রভূ কহিতে লাগিলা।।
তব বাক্য শুনি পুনঃ হইনু বিস্ময়।
জটিলার গৃহে বৃন্দা কেমনে মিলায়।।
ইহার আশয় মোরে কহ অভিরাম।
তব শক্তি করে লীলা অতি অনুপম।।
এতেক শুনিয়া পুনঃ বলেন বচন।
শুন প্রিয় শ্রীচৈতন্য করি নিবেদন।।
পৌর্ণমাসী ভগবতী সবার পূজিত।
তাজ্ঞহার হয়েন বৃন্দা সদাই আশ্রিত।।
কৃপা করি পৌর্ণমাসী বৃন্দাকে লইলা
সঙ্গেতে করিয়া তারে জাবট আইলা।।
শুনিয়া জটিলা দেবী আইলা তখন।
পৌর্ণমাসী লইয়া গৃহে করিলা গমন।।
তখন রাধিকা আসি আসন যে দিলা।
চরণ ধৌত আসি জটিলা করিলা।।
সর্ব্ব বয়োধিকা সেই হয় পৌর্ণমাসী।
অতএব হয় তার সবে দাসদাসী।।
তার সঙ্গে রহে বৃন্দা একত্রে বসিয়া।
জটিলা সুধান তারে বিনয় করিয়া।।
কহ কহ পৌর্ণমাসী করি নিবেদনে।
তব সঙ্গে রহে ইহ হয় কোন জনে।।
রূপে গুণে দেখি অতি হয়েন উজ্জ্বলা।
ব্রজের রমণী হইতে উৎকৃষ্টাতে বরা।।
বিবরিয়া কহ মোরে ইহার নির্ণয়।
শুনিতে হইল বাঞ্ছা কহি যে নিশ্চয়।।
এতেক শুনিয়া তাহা কহে পৌর্ণমাসী।
সিদ্ধ কন্যা বৃন্দা নাম হয় মোর দাসী।।
শুনিয়া জটিলা বহু প্রশংসা করিলা।
তখন রাধিকা লয়ে বৃন্দাকে সঁপিলা।।
পুনশ্চ জটিলা তারে কহে প্রিয়বাণী।
আমার বধূকে লয়ে বেড়াবে আপনি।।
সূর্য্য পূজা করিবারে বধূ মোর যায়।
আপনি হইবে বৃন্দা সকল সহায়।।
আজি হৈতে এই বধূ তোমারে যে দিনু।
পৌর্ণমাসী হৈতে গুণ তোমার জানিনু।।
এই ত কহিনু সেই বৃন্দার মিলন।
মাধুর্য্য ভাবের এই কহি যে লক্ষণ।।
তথাহি শ্রী ভক্তিরসামৃত সিন্ধুতে—
তত্তদ্ভাব মাধুর্য্যাদি শ্রুতি ধৈর্য্যাদপেক্ষতে।
নাত্রশাস্ত্রং ন যুক্তিশ্চ তল্লাভঃ প্রীতি লক্ষণঃ।।
সেই ত রাধার সনে রহে গোপীগণ।
শুদ্ধ মাধুর্য্য রস করেন চর্ব্বন।।
শাস্ত্র যুক্তি নাহি জানে কৃষ্ণ প্রাপ্তি আশা।
লোভেতে হরিলা চিত্ত আর কি জিজ্ঞাসা।।
শ্রীচৈতন্য অভিরাম পদে যার আশ।
অভিরাম লীলামৃত কহে রামদাস।।
।। ইতি গোপীকা বস্ত্রহরণ নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।।