অন্তর্দ্বীপ পরিক্রমা
দ্বাপর যুগেতে কৃষ্ণ ব্রজে বিহরয়।
তার মায়া বশে কেবা মোহিত না হয়।।
আনের কা কথা ব্রহ্মা মোহিত হইলা।
সখা সহ শ্রীকৃষ্ণের গোবৎস হরিলা।।
করিতে ব্রহ্মার দর্প চূর্ণ সেই ক্ষণে।
সকল গোবৎস সখা হইলে আপনে।।
স এ লীলা ব্রহ্মা বুঝিতে না পারে।
পড়িয়া ফাঁফরে ব্রহ্মা স্থির হৈতে নারে।।
সাপরাধ হৈয়া কৃষ্ণে বহু স্তুতি কৈল।
স্তুতি বশে শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ হৈল।।
তথাপি ব্রহ্মার নহে স্বচ্ছন্দ অন্তর।
কৈলু অপরাধ চিত্তে চিন্তে নিরন্তর।।
মনে মনে বিচারয়ে বসিয়া নির্জনে।
না দেখি উপায় চৈতন্যাবতার বিনে।।
কলির প্রথমে প্রভূ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
অবতীর্ণ হইয়া করিব কলি ধন্য।।
নবদ্বীপে করিলে প্রভূর আরাধনা।
করিবেন পূর্ণ প্রভূ মনের বাসনা।।
দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের গোপবালক রূপে ব্রজে বিহার দেখে মোহিত হয়ে ব্রহ্মা মনে করলেন ইনি ই কি ভগবান, পরীক্ষা করে দেখিতো। তিনি সখা সহ গোবৎস হরণ করে নিলেন। তখন ব্রহ্মার দর্প চূর্ণ করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত সখা ও গোবৎস রূপে প্রকট হলেন। কৃষ্ণের এই লীলা দেখে ব্রহ্মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে কৃষ্ণের বহু স্তুতি করতে লাগলেন। ব্রহ্মার স্তুতিতে শ্রীকৃষ্ণ তাকে অনুগ্রহ করলেন। তাও ব্রহ্মা বারবার নিজের অপরাধের কথা ভেবে অনুশোচনা করতে লাগলেন, হায় আমায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বঞ্চনা করে ব্রহ্মান্ডের অধিপতি করে রেখেছেন। কবে প্রভূর কৃপায় আমখর এই কর্মগ্রন্থি ছিন্ন হবে, কবে অভিমান ক্ষয় হয়ে আমার মন শুদ্ধ হবে। নবদ্বীপ বাসীগণের মত ভাগ্য কি আমার হবে বিনা আয়াসে যারা ব্রজের দুর্লভ প্রেম সেবা লাভ করবে, মনে মনে এই বিচার করে তিনি ঠিক করলেন কলিযুগে নবদ্বীপে মহাবদান্য চৈতন্য অবতার হবে। তিনি অবশ্য এই অপরাধ থেকে মুক্ত করবেন। তার কৃপায় আমার অধিকার বুদ্ধি ক্ষয় হবে ও গৌরপদাশ্রয় করে সেবা অধিকার লাভ হবে। এইরূপ চিন্তা করে ব্রহ্মাজী চৈতন্য মহাপ্রভূর আরাধনা করতে লাগলেন। ভক্তবৎসল দয়াময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ উজ্জ্বল গৌর বর্ণ প্রভায় দশদিক আলোকিত করে প্রকট হলেন। ব্রহ্মাজী অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে বহু স্ততি করলেন। মহাপ্রভূ ব্রহ্মাজীকে বললেন তুমি আমার নিত্য প্রিয় ভক্ত, বর প্রার্থনা করো। ব্রহ্মা বললেন হে প্রভূ তুমি কলি যুগে যখন অবতীর্ণ হবে আমি যেন নীচ কুলে জন্ম গ্রহন করি যাতে লোকে সর্বদা আমায় ঘৃণা করে। তাতে আমার অভিমান মোচন হবে। কিন্তু আমার যেন শ্রী হরিনামে গাঢ় রতি হয়। সর্বদা যেন তোমার ভক্তের সঙ্গ পাই। এত বলে ব্রহ্মাজী বললেন প্রভূ তুমি স্বতন্ত্র ঈশ্বর তুমি নদীয়ায় যে লীলা করবে তা কৃপা করে আমায় বলুন। ব্রহ্মার কথায় তুষ্ট হয়ে শ্রীমন্মহাপ্রভূ তাকে অন্তরের কথা কিছু বললেন। কলির প্রথম সন্ধ্যায় আমি ভক্তভাব নিয়ে ভক্তিরস নিজে আস্বাদন করব ও দুর্লভ সঙ্কীর্তন প্রকাশ করব। তারপর মহাপ্রভূ নিজ হৃদয়ের তিন বাঞ্ছা ব্রহ্মার কাছে প্রকাশ করলেন। তার অন্তরের গূঢ় কথা ব্যাক্ত করেছিলেন বলে নাম এই দ্বীপের নাম হয় অন্তর্দ্বীপ।
কহি অন্তরের কথা হৈল অন্তর্ধান।
এই হেতু লোকে ব্যাক্ত অন্তর্দ্বীপ নাম।।
অন্তর্দ্বীপের দর্শনীয় স্থান:-
১) শ্রী চৈতন্য জন্মস্থান যোগপীঠ
ভক্তিরত্নাকরে বলা হয়েছে, নবদ্বীপের অন্তর্গত অন্তর্দ্বীপের মধ্যে মায়াপুর নামকস্থানে গৌরসুন্দর আবির্ভূত হন। বৃন্দাবনে যেমন যোগপীঠ এ রাধাকৃষ্ণের মিলন হয় তেমন নবদ্বীপে মায়াপুর নামক স্থানে রাধা কৃষ্ণের মিলিত স্বরূপ গৌরসুন্দর প্রকট হন।
নবদ্বীপ মধ্যে মায়াপুর নামে স্থান।
যথা জন্মিলেন গৌরচন্দ্র ভগবান।।
যৈছে বৃন্দাবনে যোগপীঠ সুমধুর।
তৈছে নবদ্বীপে যোগপীঠ মায়াপুর।।
২) শ্রীবাস অঙ্গন
মহাপ্রভূ প্রতিদিন শ্রীবাস অঙ্গন এ নাম সঙ্কীর্তন করতেন। শ্রী চৈতন্য ভাগবতে
শ্রীবাস মন্দিরে প্রতি নিশায় কীর্তন।
কোন দিন হয় চন্দ্রশেখর ভবন।।
অদ্ভূত আবেশে এই পথে বিশ্বম্ভর।
ধাইয়া গেলেন হর্ষে শ্রীবাসের ঘর।।
শ্রীবাস ভবনে এই ঘরে দ্বার দিয়া।
পূজয়ে নৃসিংহদেবে নিমগ্ন হৈয়া।।
করে পদাঘাত গৌরচন্দ্র এই দ্বারে।
শ্রীবাসের ধ্যানভঙ্গ হৈল সে হুঙ্কারে।।
ধ্যানভঙ্গ ক্রোধে বিপ্র চাহে চারি পানে।
দেখে তেজোময় বিশ্বম্ভরে বীরাসনে।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চারি হাতে লৈয়া।
করয়ে গর্জন কত শ্রীবাসেরে কৈয়া।।
শ্রীবাস ত্রাসেতে স্তব্ধ কিছুই না স্ফুরে।
প্রভূর আজ্ঞায় হর্ষ হৈয়া স্তুতি করে।।
প্রভূর অদ্ভূত ক্রিয়া যে যে অবতারে।
তাহা প্রকাশয়ে সে আবেশে স্তুতি দ্বারে।।
সর্ব শাস্ত্রে পন্ডিত শ্রীবাস মহাশয়।
প্রভূ আগে করে স্তুতি উথলে হৃদয়।।
শুনিয়া অদ্ভূত স্তুতিভঙ্গি গৌরহরি।
দিলেন স্বাভীষ্টবর অনুগ্রহ করি।।
গোষ্ঠী সহ শ্রীবাসের ভাগ্যের সীমা নাই।
প্রভূর চরণ পূজে শ্রীবাস এথাই।।
ওহে শ্রীনিবাস এই শ্রীবাস অঙ্গণে।
নাচে গৌরচন্দ্র নিত্যানন্দ সঙ্কীর্তনে।।
দুই প্রভূ নাচে চতুর্দিকে ভক্তগণ।
যে প্রেম আবেশ তাহা না হয় বর্ণন।।
সাতপ্রহরিয়া ভাবের প্রকাশ
ওহে শ্রীনিবাস একদিন গোরা রায়।
নিজ গৃহ হৈতে শীঘ্র আইলা এথায়।।
শ্রীবাসের প্রতি প্রভূ কহেন হাসিয়া।
অদ্বৈত আইসে মোর পূজাসজ্জা লৈয়া।।
মোর ঠাকুরালী দেখিবারে ইচ্ছা তার।
এত কহি প্রেমাবেশে করয়ে হুঙ্কার।।
ওহে শ্রীনিবাস এথা হৈতে গৌররায়।
এই বিষ্ণুমন্ডপে বৈসে বিষ্ণুর খট্টায়।।
চতুর্দিকে বেষ্টিত হইয়া ভক্তগণ।
প্রভূর শ্রীমুখচন্দ্র করে নিরীক্ষণ।।
নিত্যানন্দ ছত্র ধরে মস্তক উপর।
শ্রীবদনে তাম্বুল যোগায় গদাধর।।
৩) গদাধর অঙ্গন
প্রভূর ইঙ্গিতে গদাধর এইখানে।
রচয়ে প্রভূর বেশ পুষ্পের ভূষণে।।
দাস গদাধর প্রভূ প্রিয় নরহরি।
বেশের সামগ্রী সব দেন সজ্জ করি।।
ভুবনমোহন বেশ রচিল প্রভূর।
যে বারেক দেখে তার ধৈর্য্য যায় দূর।।
বেশের সুষমা যে উপমা নাই তায়।
মুরুছয়ে কাম কোটি অঙ্গের ছটায়।।
প্রভূ প্রিয়গণ চাহি চান্দমুখপানে।
যেরূপ হইলা তা কহিতে কে বা জানে।।
আপনা নিছয়ে ভাব আবেশ সবার।
করে আরাত্রিক সুখ শোভা নাই পার।।
৪) অদ্বৈত অঙ্গন
এথা শ্রী অদ্বৈত আদি প্রভূ প্রিয় গণ।
জীবের কুমতি দেখি করয়ে ক্রন্দন।।
বিশ্বরূপ বাখানয়ে কৃষ্ণভক্তি সার।
শুনিয়া অদ্বৈত দেব করয়ে হুঙ্কার।।
বিশ্বরূপ কোলে লইয়া অদ্বৈত নাচয়।
এথা সর্ব ভক্তের আনন্দ অতিশয়।।
এথা বসি কৃষ্ণের চরিত্র সবে কয়।
শুনি নিজ কথা আইলা শচীর তনয়।।
দিগম্বর ধূলায় ধূসর সবে দেখি।
হইলা মুগ্ধ কেহ ফিরাইতে নারে আঁখি।।
এথা দাঁড়াইয়া বিশ্বম্ভর হর্ষ চিতে।
বিশ্বরূপে কহে চল ভোজন করিতে।।
এই পথে ধরি বিশ্বরূপের বসন।
ঘরে চলে সে অদ্ভূত ভঙ্গিতে গমন।।
৫) মুরারী গুপ্তের শ্রীপাট
এই পথে মুরারীগুপ্তের আগমন।
জ্ঞানব্যাখ্যাকালে করে হস্তের চালন।।
প্রভূ সেই রূপে তারে বিদ্রূপ করয়।
তাঁর গৃহে গেলা তাঁর ভোজন সময়।।
মুতিলেন তার খালে কহি তত্ত্বজ্ঞান।
এই দেখ মুরারী গুপ্তের বাসস্থান।।
একদিন প্রভূ শ্রী বরাহ ভাবাবেশে।
গর্জ্জিয়া এ পথে চলে মুরারি আবাসে।।
এই বিষ্ণু মন্দিরে প্রবেশি বিশ্বম্ভর।
বরাহ আকার হৈলা পরমসুন্দর।।
৬) মাধাই এর ঘাট
শ্রীমাধাই প্রভূ নিত্যানন্দের আজ্ঞায়।
গঙ্গাঘাট সজ্জ করে হৈয়া দীনপ্রায়।।
গঙ্গাস্নানে যায় যে যে প্রণমিয়া।
করয়ে প্রার্থনা দৈন্য কান্দিয়া কান্দিয়া।।
শুনি মাধাইয়ের দৈন্য কে বা না কান্দয়।
মাধাইয়ের হিতচিন্তা সকলে করয়।।
এই মাধাইয়ের ঘাট যে করে দর্শন।
ভক্তি লভ্য হয়, ঘুঁচে সংসার বন্ধন।।
৭) বারকোণা ঘাট
ওহে শ্রীনিবাস প্রভূ নাচিয়া নাচিয়া।
গঙ্গাতীরে যায় তাঁর সৌভাগ্য লাগিয়া।।
এই নিজঘাটে কতক্ষণ নৃত্য করি।
মাধাইয়ের ঘাট দিয়া চলে ধীরি ধীরি।।
এই বারকোণা ঘাট দেখ শ্রীনিবাস।
এথা নৃত্যগীতে কৈলা অদ্ভূত বিলাস।।
এই নগরিয়া ঘাটে রহি কতক্ষণ।
গঙ্গাতীর হৈতে করে এ পথে গমন।।
এই বারকোণা ঘাটে শুক্লাম্বর পন্ডিতের ঘর ছিল। উদ্ধব দাসের পদে—
তাহার ঈশান কোণে বারকোনা ঘাট নামে
যাহা হয় শুক্লাম্বর আশ্রম
৮)ক্ষেত্রপাল শিব
এই নবদ্বীপে ক্ষেত্রপাল শিব হয়।
অপার মহিমা লিঙ্গরূপে বিলসয়।।
নাচিলেন প্রভূর কীর্ত্তনে মূর্ত্তি ধরি।
তাঁর অভিলাষ পূর্ণ কৈল গৌরহরি।।
৯) বল্লাল দিঘি বা পৃথু কুন্ড
১০) শিবডোবা
১১) নন্দন আচার্য্যের ভবন
এথা প্রভূ শ্রীবাসাদি সকল ভক্তেরে।
নিত্যানন্দ গমন জানান ঠারেঠোরে।।
অকস্মাৎ নিত্যানন্দ আসি নদীয়ায়।
রহিলেন গুপ্তে তা জানিলা গৌররায়।।
নিত্যানন্দ অন্য অগোচর জানাইয়া।
তারে মিলিবারে চলে এই পথ দিয়া।।
শ্রীনন্দনাচার্য্য পরম ভাগ্যবান।
দেখ শ্রীনিবাস এই ভবন তাঁহার।।
ভক্তগোষ্ঠী সহ প্রভূ গিয়া এ ভবনে।
দেখে নিত্যানন্দ বসি আছয়ে ধেয়ানে।।
নিরুপম নিত্যানন্দের অঙ্গের মাধুরী।
দাঁড়াইয়া ভক্তগণ দেখে নেত্র ভরি।।
নিত্যানন্দ সম্মুখে বিলসে বিশ্বম্ভর।
নিত্যানন্দ দেখে প্রভূ শোভা মনোহর।।