নিম্বার্কাচার্য্য কৃত বেদান্ত দশশ্লোকী ভাষ্যে ৫
অঙ্গেতু বামে বৃষভানুজাং মুদা
বিরাজমানামনুরূপসৌভগাম।
সখীসহস্রৈঃ পরিসেবিতাং
সদা স্মেরম দেবীং সকলেষ্টকামদাম্।।
অনুবাদ:- সেই পরমপুরুষের বাম ভাগে সর্বদা বৃষভানুজা রাধা অবস্থান করেন। যিনি অনুরূপ সৌভাগ্য ও নিরতিশয় আনন্দের মূর্তি। সর্বদা অসংখ্য সখীগণ তাকে সেবারতা। তিনি সকল অভীষ্ট প্রদানকারিনী। তাকে সর্বদা স্মরণ করি।
লঘুমঞ্জুষা টীকার অনুবাদ:-
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বামভাগে বৃষভানুজা অর্থাৎ রাধিকা সদা অর্থাৎ সবসময় বা নিত্য ও সর্বাবস্থায় বিরাজমানা। তু শব্দে রমা সত্যভামাদিকে বোঝানো হয়েছে। এবং অন্য সকল বিশেষণ ও এই দেবীত্রয়ের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে বুঝতে হবে। কিভাবে অবস্থান করেন? মুদা অর্থাৎ নিরতিশয় আনন্দের মূর্তি স্বরূপে। বিরাজমান শব্দের অর্থ বিশেষ রূপে স্বরূপ বিগ্রহ বা প্রেমকারূণ্যাদি গুণ সহ রাজতে অর্থাৎ দীপ্তিমানা হয়ে অবস্থান করা বোঝায়।
তথা ঋকপরিশিষ্ট শ্রুতিতেবলা হয়েছে— “রাধয়া মাধবো দেবো মাধবেন চ রাধিকা।" এইবাক্যে মাধব শব্দে রমাপতি ও চ শব্দে সত্যভামাদি কে বোঝানো হয়েছে। এই শ্রুতিতে রাধা, লক্ষ্মী বা রুক্মিনী ও সত্যভামা দেবীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যসম্বন্ধ সূচিত হয়েছে।
কিরকম অনুরূপ সৌভগাং অর্থাৎ ভগবানশ্রীকৃষ্ণের মত সৌভগং অর্থাৎ শোভন ও ভগবদ ঐশ্বর্য্য শালী। কারন তিনি ও শ্রীকৃষ্ণ একাত্মা, শ্রীকৃষ্ণের শক্তি। তাই তার মধ্যেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরমত গুন ঐশ্বর্য্যাদি প্রকট হয়েছে। ব্রহ্মান্ডপুরাণে তাই বলা হয়েছে—
“রাধা কৃষ্ণাত্মিকা নিত্যং কৃষ্ণো রাধাত্মকো ধ্রুবম্।"
গৌতমীয় তন্ত্রে বলা হয়েছে—
পুরুষঃ কৃষ্ণসর্বাত্মা সা শক্তিঃ সর্বদেবতা।
বরাভয়করস্থা যা সেবিতা সর্বদৈবতৈঃ।।
আবার গোপালউত্তরতাপনী মন্ত্রে বলা হয়েছে—
কৃষ্ণাত্মিকা জগদ্ধাত্রী মূলপ্রকৃতিরুক্মিণী।
ব্রজস্ত্রীজনসম্ভূতা শ্রুতিভ্যো ব্রহ্মসঙ্গতা।।
তারপর বলা হচ্ছে তিনি কিভাবে নিত্য অবস্থান করেন। সখীসহস্রৈঃ পরিসেবিতাম। অনন্ত সখীগন পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি অবস্থান করেন। সখী অর্থাৎ দিব্যপরিচারিকা গণ দ্বারা সম্যক রূপে সেবিত হন। যদি প্রশ্ন হয় প্রাকৃত রাজাগণের রাণী গণ ও তো বহু দাসদাসী পরিবৃতা হয়ে সেবিত হন। তাতে বিশেষ কি আছে? তার উত্তরে বলা হচ্ছে তিনি দেবী। দেব অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রের প্রতিপাদ্য (ভর্গো দেবস্য) শ্রীকৃষ্ণের পত্নী তাই তিনি দেবী।
তাই গৌতমীয় তন্ত্রে
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।
স্বরূপাৎ দ্বিভূজা চিত্রবসনাভরণান্বিতা।।
ও গোপালতাপনী মন্ত্রে
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা কৃষ্ণদেবতা।
সর্বলক্ষ্মীময়ী সর্বকান্তিসম্মোহিনী পরা।।
এখানেও রাধার সঙ্গে রমা সত্যভামাদিকেও বোঝানো হয়েছে। “শ্রিয়ং দেবীমুপাস্মহ" ইত্যাদিশ্রুতিমন্ত্রেও রমা সত্যভামাদিরও দেবীত্য প্রতিপাদিত হয়েছে।
যদি প্রশ্ন হয় ব্রহ্মা, রুদ্র, ইন্দ্রাদি দেব পত্নীগণ ও দেবী তাদের কে কেন স্মরণ করব না। তার উত্তরে বলা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট কারন “সকলেষ্টকামদাম", অর্থাৎ সকল ইষ্ট,কামনা ও পদ প্রদান কারী। সকল বলতে চতুর্বিধ ভক্ত যথা কামী, আর্ত, কর্মী ও জ্ঞানীর কথা বলা হয়েছে। তাদের ইচ্ছা অনুসারে তিনি পুরুষার্থ চতুষ্টয় দানকরেন।
তাই পঞ্চরাত্র এ বলা হয়েছে
রাধয়া সহিতং কৃষ্ণং যঃ পূজ্যতি নিত্যশঃ।
ভবেদ্ভক্তির্ভগবতি মুক্তিস্তস্য করে স্থিতা।।
অথবা, সকলের অর্থাৎ ব্রহ্মাদি সমস্ত জীবের যাদের সৃষ্টি স্থিতি ও লয় হয় তাদের নিজ নিজ অভীষ্ট প্রদান করেন। লীলাস্বরূপে ও কৃষ্ণ শক্তি বলে তিনি সর্বত্র ব্যাপ্তা তাই সকলকে ফল দানে সমর্থা এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই।
আবার স্মৃতি শাস্ত্রেও বলা হয়েছে রমাদেবীও সকলপ্রকার অভীষ্ট দানে সমর্থা। যথা—
যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনে।
আত্মবিদ্যা চ দেবী ত্বং বিমুক্তিফলদায়িনী।।
ভূদেবী স্বরূপা সত্যভামাদেবীও সর্ব অভীষ্ট পূরণে সমর্থা।
রাধিকা রুক্মিণী ও সত্যভামাদিবিশিষ্ট পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণই সর্বদা উপাস্য। সম্প্রদায় ভেদ এ নিজ নিজ প্রীতি অনুসারে দ্বিভূজ বা চতুর্ভূজ স্বরূপে উপাসনা হয়। উভয় বিধ স্বরূপে কোন তারতম্য নেই। তাই আদি বরাহপুরাণে বলা হয়েছে
মথুরায়াং বিশেষেণ মাং ধ্যায়ন্ মোক্ষমশ্নুতে।
শ্লোক থেকে শুরু করে
শ্রীবৎসলাঞ্ছনং হৃৎস্থকৌস্তুভপ্রভয়া যুতম্।। ৫
চতুর্ভূজং শঙ্খচক্রশার্ঙ্গপদ্মগদান্বিতম্।
হিরন্ময়ং সৌম্যতনুং স্বভক্তায়াভয়প্রদম্।।
ধ্যায়েন্মনাসি মাং নিত্যং বেণুশৃঙ্গধরং তু বা।
সৎপুন্ডরীকনয়নং মেঘাভং বৈদ্যুতাম্বরং।।
এই ভাবে দ্বিভূজ ও চতুর্ভূজ উভয়বিধ স্বরূপের ধ্যান ই মোক্ষলাভের কারন বলা হয়েছে। সম্প্রদায় ভেদে ভিন্ন স্বরূপে ধ্যান করা হলেও দুইস্বরূপ ই তুল্যফল প্রদাণকারী।