পরমাত্ম সন্দর্ভ অনুচ্ছেদ ১৪০
তদেব পাদ্মোত্তর খন্ডে দেবীং প্রতি পাষন্ডশাস্ত্র গণনে শ্রী মহাদেবেনোক্তং
মায়াবাদমসচ্ছাস্ত্রং প্রচ্ছন্নং বৌদ্ধমুচ্যতে।। ৭০
ময়ৈব কথিতং দেবী কলৌ ব্রাহ্মণরূপিণা।
অপার্থং শ্রুতিবাক্যানাং দর্শয়ল্লোকগর্হিতম্।। ৭১
কর্মস্বরূপত্যাজ্যত্বমত্র বৈ প্রতিপাদ্যতে।
সর্বকর্মপরিভ্রষ্টং বৈধর্ম্যত্বং তদুচ্যতে।। ৭২
পরেশজীবয়োরৈক্যং ময়া তু প্রতিপাদ্যতে।
ব্রহ্মণোঽস্যস্বয়ং রূপং নির্গুণং বক্ষ্যতে ময়া।।৭৩
সর্বস্য জগতোঽপ্যত্র মোহনার্থং কলৌ যুগে।
বেদার্থবন্মহাশাস্ত্রং মায়য়া যদবৈদিকম্।। ৭৪
ময়ৈব রক্ষ্যতে দেবী জগতাং নাশকারণাৎ।
তচ্চাসুরাণাং মোহনার্থং ভগবত এবাজ্ঞয়েতি।
অনুবাদ:- ঐ মায়াবাদ কে অসৎ শাস্ত্র বলা হয়েছে যথা পদ্মপুরাণের উত্তর খন্ডে দেবীর প্রতি পাষন্ডশাস্ত্রগণনা প্রসঙ্গে মহাদেব বলেছেন
হে দেবী বুদ্ধমতাবলম্বী প্রচ্ছন্ন মায়াবাদ নামে যে অসৎ শাস্ত্র রয়েছে তা কলিকালে আমিই ব্রহ্মণমূর্ত্তিতে বলেছি। এই শাস্ত্রে শ্রুতিবাক্যের অন্য অর্থ করেছি ও কর্মকান্ড ত্যাগ করার কথা বলেছি তাই একে বিধর্ম্ম বলা হয়। পরমেশ্বর ও জীবের ঐক্য প্রতিপাদন করেছি ও ব্রহ্ম এর রূপ কে আমি নির্গুণ বলেছি, এই সব ই এই জগতকে মোহনের জন্য। হে দেবী মহাশাস্ত্র বেদান্তেও যে অবৈদিক মায়া কল্পিত হয়েছে তা জগতের নাশের নিমিত্ত।
এবং দেবাদিদেব শঙ্কর অসুর দের মোহিত করার জন্য ভগবানের আজ্ঞায় এই রূপ অসৎ শাস্ত্র রচনা করেছেন তা পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে।
পরমাত্ম সন্দর্ভ অনুভাষ্য
পূর্বপক্ষ:- পদ্মপুরাণে শিবের অন্য কোনো অবতারের কথা আছে ইনি শঙ্করাচার্য্য নন। কারন কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে শঙ্করাচার্য্য শিবের অবতার ও তিনি শ্রুতি স্মৃতি প্রচার করেন
সিদ্ধান্ত:- কূর্মপূরাণ পূর্ব/৩০/৩৪-৩৫ এ বলা হয়েছে
শ্রৌতস্মার্ত্তপ্রতিষ্ঠার্থ ভক্তানাং হিতকাম্যয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তজ্জ্ঞানং শিষ্যাণাং ব্রহ্মসংজ্ঞিতম্।।
সর্ববেদান্তসারং হি ধর্মান্বেদনিদর্শিতান্।
সর্ববর্ণান্ সমুদ্দিশ্য স্বধর্মা যে নিদর্শিতাঃ।।
নীললোহিত শঙ্কর কলিযুগে শ্রৌত ও স্মার্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ভক্তদের হিতকামনায় অবতার গ্রহণ করবেন। তিনি শিষ্য দের সমস্ত বেদান্তের সাররূপ ব্রহ্মজ্ঞান ও বেদ নির্দ্দিষ্ট ধর্ম উপদেশ করবেন।
এই কূর্মপুরাণের শ্লোকে বলা হয়েছে কলিযুগে শিব অবতীর্ণ হয়ে তার শিষ্য দের বেদান্ত, বেদ, ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ করবেন। আর পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে শিব কলিযুগে অবতীর্ণ হয়ে বেদ
উপদেশ করবেন কিন্তু বেদ এর অন্য অর্থ করে তা উপদেশ করবেন। “অপার্থং শ্রুতিবাক্যানাং দর্শয়ল্লোকগর্হিতম্।।"
তাই পদ্মপুরাণে শিবের অন্য কোনো অবতারের কথা বলা হয়নি। শঙ্কর ভগবৎপাদের কথাই বলা হয়েছে।
এবং পদ্মপুরাণের শ্লোকের অন্যান্য বর্ণনাও আচার্য্য শঙ্কর এর সাথেই মেলে যেমন শিব ঐ অবতারে
১) প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত প্রচার করেন(আচার্য্য শঙ্কর ভগবৎপাদ ই যে বৌদ্ধ জৈন দের সনাতন ধর্মে আকর্ষণের জন্য বেদান্তে বৌদ্ধ মত ই আছে বলে প্রচার করেন তা আগেই দেখানো হয়েছে।)
২) মায়াবাদ প্রচার করেন (অদ্বৈতবাদীরা অবশ্য বলে থাকেন মায়াবাদ মানে সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ শঙ্কর মায়াবাদ প্রচার করেননি।)
৩) জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য প্রচার করেন
৪) ব্রহ্ম কে নির্গুণ বলে প্রচার করেন।
৫) কর্মকান্ডের অসাঢ়তা দেখিয়ে জ্ঞানকান্ডের প্রচার করেন।
বরাহপুরাণ এ ও মহাদেব বলেছেন
যে রুদ্রামুপজীবন্তি কলৌ বৈদান্তিকা নরাঃ।
লৌল্যার্থিনঃ স্বশাস্ত্রাণি করিষ্যন্তি কলৌ নরাঃ। ৭০/৫৫
অনুবাদ:- কলিযুগে বৈদান্তিক গণ অর্থের লোলুপ হয়ে রুদ্রপর ব্যাখ্যা করে শাস্ত্র রচনা করবে। কিন্তু আমি তাদের সঙ্গে থাকিনা।
অর্থাৎ আচার্য্যের শিষ্যগণ ও মোহিত হয়ে বেদান্তের কদর্থ ব্যাখ্যা আরম্ভ করবেন। কিন্তু পরম বৈষ্ণব মহাদেব বলেছেন তিনিও এই সকল বৈদান্তিক দের সঙ্গে থাকেন না
পূর্বপক্ষ:- অদ্বৈতবাদ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মত নয় পদ্মাপুরাণে অন্য কারোর কথা বলা হয়েছে
সিদ্ধান্ত:- ১) অদ্বৈতবাদ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ কেন?
যারা বেদ মানেনা তারাই বৌদ্ধ। এখন অদ্বৈতবাদীদের কাছে প্রশ্ন আপনারা বেদ কে সত্য মানেন না ব্যাবহারিক সত্য মানেন?
যদি সত্য বলেন তাহলে অদ্বৈত থাকেনা। বেদ এর উপদেশের প্রয়োজন জীব এর জন্য। অদ্বৈতবাদে জীব ও ব্রহ্ম অভেদ তবে ঈশ্বর কার জন্য বেদ উপদেশ করেছেন?
অতএব বেদ এর ব্যাবহারিক সত্যতা আছে পারমার্থিক সত্যতা নেই। বেদ কে সত্য মানতে গেলে জীব ও ব্রহ্মের ভেদ সত্য মানতে হবে। যা অদ্বৈতে কখনোই সম্ভব নয়। তাই অদ্বৈতবাদ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ।
যেমন জগৎ ব্যাবহারিক সত্য বলে অদ্বৈতবাদীরা জগৎকে মিথ্যা বলো সেরকম বেদ এর ও কেবলমাত্র ব্যাবহারিক সত্যতার কারনে বেদ ও মিথ্যা হয়ে যায়। তাই অদ্বৈতবাদীরা প্রচ্ছন্নবৌদ্ধ।
২) গৌড়পাদের মান্ডুক্য কারিকার চতুর্থকারিকা অলাতশান্তি প্রকরণ মাধ্যমিক বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত অনুসরণেই রচিত হয়েছে।
৩) অদ্বৈতবাদ ও বৌদ্ধ দর্শনের সাদৃশ্য
অদ্বৈতবাদের নির্গুণ ব্রহ্ম ও নাগার্জুনের শূণ্য এই দুটিও একই। বৌদ্ধগণ মনে করতেন এই দৃশ্যমান জগতের কারন রূপে কিছুই নেই, অদ্বৈত মতে এই সমস্তের পিছনে কারন রূপে একটি পরম সত্য অবশ্যই আছে। তা হল নির্বিশেষ ব্রহ্ম। এই ব্রহ্ম শূণ্য নয়। তার অস্তিত্ব বা সত্ত্বা আছে। অদ্বৈতবাদে ও জগৎ মিথ্যা, বৌদ্ধ মতেও জগৎ মিথ্যা। উভয়মতেই দৃশ্যমান জগতের সত্যত্ব কেবল ব্যাবহারিক, পারমার্থিক নয়।
শঙ্করমতে জীব কোনো স্বতন্ত্র তত্ত্ব নয় জীব ও ব্রহ্ম, বৌদ্ধমতে জীব শূণ্য। (তবে শঙ্করাচার্য্য আত্মার নিত্যতা স্বীকার করেছেন। বৌদ্ধমতে আত্মা র অস্তিত্ব ক্ষণিক স্থায়ী।)
শঙ্করাচার্য্যের ব্যাবহারিক ও পারমার্থিক এই দুই ভেদ মাধ্যমিক বৌদ্ধ মতে সম্বৃতি ও পরমার্থের তুল্য। শঙ্করাচার্য্যের মোক্ষ ও বৌদ্ধমতের নির্বাণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
এভাবে গৌড়পাদ ও শঙ্করাচার্য্যের সিদ্ধান্ত গুলি বৌদ্ধ আচার্য্য নাগার্জুনের মাধ্যমিক বৌদ্ধমত বা শূণ্যবাদের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য পূর্ণ। তাই শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ কে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মত বলা হয়েছে।
বলদেব বিদ্যাভূষণ সুক্ষ্মাটীকায় বলেছেন শূণ্যবাদ মতে এই জগতে সব ই শূণ্য। কিন্তু সম্বৃতি র অবচ্ছেদে সেই শূণ্য ই নানাকার জগৎ রূপে অধ্যস্ত হয়। যদিও ঐ শূণ্যের কোনো পারমার্থিক সত্ত্বা নেই। তবু সংবৃত্তির সত্যতার জন্য জাগতিক বস্তুকে সদ বলে মনে হয়। বাক ও মনের অগোচর শূণ্য ই তত্ত্ব। মুক্তি অর্থাৎ শূণ্যভাবপ্রাপ্তি।
অদ্বৈতবাদীদের মতে ও একমাত্র ব্রহ্ম ই সত্য। ব্যাবহারিক দশায় ব্রহ্ম ই জগৎ রূপে বিবর্ত্তিত হয়। বাক ও মনের অগোচর ব্রহ্ম ই তত্ত্ব। ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তিই মুক্তি,
সবকিছু শূন্য মেনে নেওয়ায় বৌদ্ধ রা দৃশ্যমান জগৎ ও সকল বস্তুকে স্বপ্ন ব্যাবহারবৎ মানেন। শঙ্কর ও ব্রহ্ম কে অনির্বচনীয় মেনে নিয়েছেন তাই মায়া শক্তি ও জগৎ কে ব্যাবহারিক মানেন।
বিবেক চূড়ামণিতে শঙ্করাচার্য্য মায়ার সম্পর্কে বলেছেন
সন্নাপ্যসন্নাপ্যুভয়ত্মিকা নো ভিন্নাপ্যভিন্নাপ্যুভয়াত্মিকা নো।
সাঙ্গাপ্যনঙ্গাপ্যুভয়াত্মিকা নো
মহাদ্ভুতাঽনির্বচনীয়রূপা।।
বৌদ্ধ দের মতে জগত ও পরম তত্ত্ব উভয়েই এই চতুষ্কোটির উর্দ্ধে এক অনির্বচনীয় তত্ত্ব।
যোগাচার দের বিজ্ঞানবাদের মতে সবকিছু শূন্য হলেও জ্ঞান সত্য। যার দ্বারা এই সংসার কে অসত্য প্রতীত হয় সেই জ্ঞান বা বিজ্ঞান ই সত্য। তাই এই দর্শন কে বিজ্ঞানবাদ বলে। চার প্রকার ভাবনা (ক্ষণিক, দুঃখ, স্বলক্ষণ ও শূন্য) এর দ্বারা সকল বাসনার নাশ হলে দ্বৈতজ্ঞান বা মিথ্যাজ্ঞান দূর হয় ও বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের জন্ম হয় তা ই মোক্ষ।
লঙ্কাবতার সূত্র এই সম্প্রদায়ের মূল গ্রন্থ। বসুবন্ধু, দিঙনাগ স্থিরমতি, মৈত্রেয়নাথ, আর্য্য অসঙ্গ, শঙ্করস্বামী প্রমুখ এই দর্শন প্রচার করেছিলেন
যেহেতু অদ্বৈতাবাদীরা বেদকে ব্যবহারিক সত্য মানে তাই সকল আচার্য্যরাই অদ্বৈতাবাদকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলেছেন
১) ব্যাসতীর্থ মাধ্যমিক শূণ্যবাদ ও শঙ্করের অদ্বৈতবাদের তুলনা করেছেন যে নাগার্জুনের মতে
ন সৎ নাসৎ ন সদসৎ নচাপ্যনুভয়াত্মক।
চতুষ্কোটিবিনির্মুক্তং তত্ত্বং মাধ্যমিকঃ জগুঃ।।
সদবাদ, অসদবাদ, সদসদবাদ, সদসদবিলক্ষণ( বা অনির্বচনীয় বা অব্যাক্তব্য বা অনুভয়াত্মক)
এই চারকোটির নিষেধেই শূন্যবাদের তাৎপর্য্য।
শঙ্করাচার্য্য তার মান্ডুক্যকারিকাভাষ্যেও ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন
অস্তিনাস্তীত্যাদিকোটিভিঃ চতুসৃভিরপি অস্পৃষ্টো অসত্যাদিবিকল্পনাবর্জিতঃ ইত্যেতদ্ যেন মুনিনা দৃষ্টো জ্ঞাতো বেদান্তেষু ঔপনিষদঃ পুরুষঃ, স সর্বদৃক সর্বজ্ঞঃ পরমার্থপণ্ডিতঃ ইত্যর্থঃ।।
(মান্ডুক্য কারিকা ভাষ্য ৪.৮০ গীতা প্রেস প্রকাশিত পৃঃ ২৫৩)
অর্থাৎ যিনি অস্তি, নাস্তি, আদি বিকল্প থেকে সর্বদা রহিত তিনিই বেদান্তে প্রতিপাদিত ঔপনিষদিক পুরুষ। এভাবে তাকে যিনি জানেন তিনি সর্বজ্ঞ। ,
২)রামানুজাচার্য্য নাভাব উপলব্ধেঃ||২|২|২৭|| সূত্র ভাষ্যে বলেছেন জ্ঞান-মাত্রম্ এব পরমার্থ ইতি সাধয়ন্তঃ সর্ব-লোকোপহাসোপকরণং ভবন্তীতি বেদ-বাদ-চ্ছদ্ম-প্রচ্ছন্ন-বৌদ্ধ-নিরাকরণে নিপুণতরং প্রপঞ্চিতম্|
জ্ঞানেরই একমাত্র পারমার্থিকতা সাধন করায় সর্বলোকের হাস্যাস্পদ হয়ে থাকে। এবিষয়ে ছদ্মবেদবাদী প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মত নিরাকরন প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
৩) শ্রী যামুনাচার্য্য তার আত্মসিদ্ধি গ্রন্থে সংবিতাত্মবাদ খন্ডণ প্রকরণে বলেছেন—
মাধ্যমিক বৌদ্ধ দের মতে জ্ঞান ই আত্মা। তাতে কোনো ভেদ নেই। কিন্তু ভ্রান্তিজ্ঞানের কারনে গ্রাহ্য গ্রাহক ইত্যাদি ভেদ দর্শন হয়।
প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধবাদী অদ্বৈতী বিদ্বান গণ ও বলেন যে শুদ্ধ তত্ত্ব ব্রহ্ম এই জগতের উপাদান কারন নয়। কারন ব্রহ্ম কে জগতের উপাদান মানা হলে এই জগত ও সত্য হয়ে যায়। তাই জ্ঞাতা জ্ঞেয় ইত্যাদি ভেদ এর উৎপাদনকারী হলো মায়া। এই প্রপঞ্চ মায়িক হওয়ার কারনেই তাত্ত্বিক জ্ঞান উৎপন্ন হলে সম্পূর্ণ প্রপঞ্চের নিবৃত্তি হয়ে যায়।
যথাহুঃ প্রকটাঃ—
অবিভাগোঽপি বুদ্ধ্যাত্মা বিপর্য্যাসিতদর্শনৈঃ।
গ্রাহ্যগ্রাহকসংবিত্তিভেদবানিব লক্ষ্যতে।।
ইতি যথা বা প্রচ্ছন্নাঃ—
শুদ্ধং তত্ত্বং প্রপঞ্চস্য ন হেতুরনিবৃত্তিতঃ।
জ্ঞাতৃজ্ঞেয়বিভাগস্য মায়ৈব জননী ততঃ।।
শঙ্করাচার্য্যের মতে শ্রুতি যেহেতু আত্মাকে স্বয়ং প্রকাশ বলে আর জ্ঞান ও যেহেতু স্বয়ং প্রকাশ তাই জ্ঞান কেই আত্মা মানা উচিত। জ্ঞান ভিন্ন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, প্রাণ, ইত্যাদি সবই দোষমূলক ও আত্মাভাস রূপ। তাই এদের কে আত্মা মানা যায়না। জ্ঞানাত্মবাদী দার্শনিক দুই প্রকার ক্ষণিক বিজ্ঞানাত্মবাদী বা বৌদ্ধ ও নিত্যজ্ঞানাত্মবাদী বা অদ্বৈতবাদী। তাই অনিত্য বা ক্ষণিক বিজ্ঞানাত্মবাদী দের প্রকট বৌদ্ধ মত ও নিত্যজ্ঞানাত্মবাদী দের প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত বলা হয়।
এই দুইমতের কেবল পার্থক্য হল বৌদ্ধ মতে আত্মা ক্ষণকাল স্থায়ী, এক ক্ষণে আত্মা উৎপন্ন হয়, তারপরের ক্ষণেই তা সন্তান ভূত জ্ঞানাত্মার উৎপাদন করে বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই আত্মা ক্ষণিক। অদ্বৈতবাদীদের মতে আত্মা ক্ষণিক নয় আবার নিত্য ও নয়, মুক্তির পর আর আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকেনা। বৈষ্ণব আচার্য্য দের মতে আত্মা নিত্য। মুক্তির পরেও আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে।
৪) ক্ষণিকত্বাৎ (২.২.৩১)ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে বল্লভাচার্য্য ও বলেছেন “মাধ্যমিকস্তু মায়াবাদিবদ্ অত্যসম্বদ্ধবাদিত্বাদ্ উপেক্ষ্যঃ"
৫) সর্বথাঽনুপপত্তেশ্চ (২.২.৩২) ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে বলদেব বিদ্যাভূষণ বলেছেন “এতেন বৌদ্ধ নিরাসেন তৎসদৃশো মায়ী চ নিরস্তঃ। ক্ষণিকত্বমনুসৃত্য দৃষ্টিসৃষ্টিবর্ণনাৎ শূন্যবাদমাশ্রিত্য বিবর্ত্তনিরূপণাচ্চ তস্য তৎসাদৃশ্যম্।।"
এভাবে বৌদ্ধমত নিরাস দ্বারা বৌদ্ধসদৃশ মায়াবাদী মত ও খন্ডণ করা হল। কারন মায়াবাদীদের মতে বস্তুর ক্ষণিকত্ব অনুসরণ করেই দৃষ্টিসৃষ্টি বর্ণনা করা হয়েছে। আর শূণ্যবাদ অবলম্বন করেই বিবর্ত্তবাদ নিরূপন করা হয়েছে। তাই বৌদ্ধমত তুল্য মায়াবাদ ও বিবর্ত্তবাদ পৃথক ভাবে খন্ডণ করা হলোনা
৬) কেবল বৈষ্ণব আচার্য রাই নয় শৈবআচার্য্য শ্রীপতিপণ্ডিতাচার্য্য তার শ্রীকরভাষ্য নামক ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য ২/২/৫-৬ এ বৌদ্ধমত খণ্ডন করে বলেছেন “এবং বুদ্ধমতং নিরস্য প্রচ্ছন্নবৌদ্ধাভিধান জীবেশ্বর জগন্মিথ্যাত্ব প্রতিপাদক শ্রুত্যাভাসপ্রধান নির্বিশেষাদ্বৈত মতমধিকরণান্তরেণ নিরাকরোতি।”
৪)মান্ডুক্যকারিকা ৪.৯৯ এ গৌড়পাদ উপসংহার এ বলেছেন
ক্রমতে ন হি বুদ্ধস্য জ্ঞানং ধর্মেষুতায়িনঃ।
সর্বে ধর্মাস্তথা জ্ঞানং নৈতদবুদ্ধেন ভাষিতম্।।
আচার্য্য শঙ্কর এর ব্যাখ্যায় বলেছেন—
জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা ইত্যাদি ভেদ রহিত এই অদ্বয় পরমার্থতত্ত্বকে ভগবান বুদ্ধ নিরূপন করেননি। এই অদ্বৈত পরমার্থতত্ত্ব বেদান্ত এর ই বিষয়। বেদান্তে তা পূর্ব থেকেই বর্ণিত ছিল। “ইদং তু পরমার্থতত্ত্বমদ্বৈতং বেদান্তেষ্বেব বিজ্ঞেয়মিত্যর্থঃ"
এখন একই মত বুদ্ধদেব প্রচার করেছেন আর শঙ্কর তা বেদান্ত সিদ্ধান্ত দ্বারা। শ্রী আদিশঙ্করাচার্য্যপাদ বলছেন এই মত বুদ্ধ নতুন কিছু বলেননি এগুলি বেদান্তে আগে থেকেই বর্ণিত ছিল। বিভিন্ন বিচার প্রণালী অবলম্বন করেও বিভিন্ন ব্যাক্তি যদি একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাদের সকলকেই একমতাবলম্বী ই বলতে হয়। শঙ্করাচার্য্য বৌদ্ধসিদ্ধান্তকে শ্রুতির আবরণে প্রচ্ছন্ন করে প্রচার করেছেন।
আচার্য্য শঙ্কর বৌদ্ধ ও জৈন দের সনাতন ধর্মে আকর্ষণের জন্য প্রচার করেন তাদের ই মতবাদ বেদান্তে আছে। এভাবে তিনি সনাতন ধর্মকে রক্ষা করেন তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও বলেছেন
আচার্য্যের দোষ নাই ঈশ্বর আজ্ঞা হৈল।
অতএব কল্পনা করি নাস্তিক শাস্ত্র কৈল।।
চৈতন্যচরিতামৃত মধ্য/৬ষ্ঠ/ ১৮০
পূর্বপক্ষ:- পদ্মপুরাণে বর্ণিত শিবাবতার বৈদিক কর্মকান্ড ত্যাগ করবেন। কিন্তু আদি শঙ্করাচার্য্য তো কর্মকান্ড জপ, যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি ত্যাগ করেননি।
সিদ্ধান্ত:- অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা এই প্রথম ব্রহ্ম সূত্রে আচার্য্য আদ্য শঙ্করাচার্য্য ভগবৎপাদ বলেছেন যস্মাদ্বেদ এবাগ্নিহোত্রাদীনাং শ্রেয়ঃসাধনানামনিত্যফলতাং দর্শয়তি— “তদ্যথেহ কর্মচিতো লোকঃ ক্ষীয়ত এবমেবামুত্র পুণ্যচিতো লোকঃ ক্ষীয়তে" তথা ব্রহ্মবিজ্ঞানাদপি পরং পুরুষার্থ দর্শয়তি— “ব্রহ্মবিদাপ্নোতি পরম্"
অনুবাদ:- এভাবে অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞের অনিত্য ফল দেখাতে উপনিষদে বলা হয়েছে—যেমন কৃষিকার্য্য ইত্যাদি দ্বারা উপার্জিত ভোগ্য পদার্থ ক্ষীণ হয়ে যায় তেমন ই পরলোকে পুণ্য দ্বারা অর্জিত সুখ ও ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু ব্রহ্ম কে জানলে সেই ব্যাক্তি মোক্ষ কে প্রাপ্ত করেন, ইত্যাদি শ্রুতির দ্বারা ব্রহ্মবিদ্যাকেই পরম পুরুষার্থ বলা হয়েছে।
(শঙ্করভাষ্য রত্নপ্রভা সহ খন্ড ১ পৃঃ৭৬-৭৭)