অবতরনিকা
জগন্নাথ দারুব্রহ্ম। শ্রীচৈতন্য ব্ৰহ্ম কল্পতরু। গঙ্গা জলব্ৰহ্ম। শ্রীচৈতন্য সজল করুণাব্ৰহ্ম। পুরুষোত্তম অচল ব্রহ্ম। শ্রীচৈতন্য সচল ব্ৰহ্ম। স্মরণাতীত কাল থেকে যত মহাপুরুষ মহাত্মা সন্ত আচাৰ্য শ্রীক্ষেত্রে শুভাগমন করেছেন তাদের মধ্যে একমাত্র শ্রীচৈতন্য ভিন্ন আর কেউ-ই ক্ষেত্ৰবাসীর কাছে ‘মহাপ্রভু’ হয়ে ওঠেন নি। উৎকল ভাষায় মহাপ্রভু বলতে একমাত্র জগন্নাথকেই বোঝায়। দুই মহাপ্রভু আজ এক হয়ে গেছেন। জগন্নাথের কথা বলতে গেলে শ্রীচৈতন্যর কথা আসে। শ্রীচৈতন্যের কথা বলতে গেলে জগন্নাথের কথা আসে। নইলে দু’টো কথাই পূর্ণ। হয় না।
জগন্নাথ দর্শন খণ্ডয়ে সংসার।
সব দেশের সব লােক নারে আসিবার ।
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু দেশে দেশে যাইয়া।
সব লােক নিস্তারিলা জঙ্গম ব্ৰহ্ম হইয়া।
পুরীর মন্দিরে শ্রী চৈতন্যদেবের প্রভাব
শ্রীক্ষেত্রে সকল সম্প্রদায়ের সকল প্রতিষ্ঠাতা আচার্য্য গণ এসেছেন কিন্তু জগন্নাথ মন্দিরের সেবা রীতিনীতিতে তাদের কোনো প্রভাব পড়েনি। একমাত্র পান্ডারা শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর বিগ্রহ ই মন্দিরে বসাতে দিয়েছে। আর কোনো আচার্য্য শঙ্কর ই হোন কি রামানুজ কারোর কোনো বিগ্রহ শ্রীমন্দিরের মধ্যে নেই। অথচ শ্রী মন্দিরের চক্রবেড়ের মধ্যে একটি নয় শ্রী চৈতন্য দেবের তিন তিনটি মন্দির রয়েছে। প্রথমটি শ্রী মন্দিরের উত্তর পূর্ব দিকে শ্রীচৈতন্যপাদপদ্ম মন্দির। এই মন্দিরের সেবা হরিদাস ঠাকুর সমাধি মঠের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়টি বাইশ পাহাচ অতিক্রম করে মন্দিরের কূর্মবেড়ে প্রবেশ করেই ডানদিকে (মন্দিরের উত্তর দিকে) দারুময় শ্রীচৈতন্যদেবের শ্রীমূর্তি সেবিত হচ্ছেন। গম্ভীরা রাধাকান্ত মঠের তত্ত্বাবধানে এই মন্দিরে সেবা সুপ্রাচীন কাল ধরে চলে আসছে। রাজা প্রতাপরুদ্র দেব এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তৃতীয়টি শ্রীমন্দিরের দক্ষিণ দ্বার বা অশ্বদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে ডানদিকে শ্রীমন্দিরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মূর্তি সেবিত হচ্ছেন। এই মন্দিরের সেবা সূপকার ব্রাহ্মণ সমাজ এর পান্ডাদের দ্বারা হয়ে থাকে
এছাড়া শ্রীমন্দিরের গায়ে দক্ষিণাভিমুখী ষড়ভূজ শ্রীগৌরমূর্তি আছে। কূর্মবেড়ের মধ্যে শ্রীমন্দিরের চতুর্দিকে যে বিরাট চত্বর আছে তাকে চৈতন্য মন্ডপ বলে। শ্রী মন্দির থেকে স্বর্গদ্বার পর্যন্ত রাস্তা গৌরবাটসাহী নামে পরিচিত।
জগন্নাথের শ্রীমন্দির ছাড়া কূর্মবেড় বা চক্রবেড়ের মধ্যে অসংখ্য মন্দির রয়েছে। তারমধ্যে কোনো মন্দিরে কখনো ঘন্টা বা কোনো বাদ্যের ধ্বনি হতে পারেনা কেবল নবমীর দিন বিমলা মন্দিরে সাময়িক বাদ্যভান্ড হয়ে থাকে। একমাত্র প্রতাপরুদ্রদেব প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত গৌরাঙ্গ মন্দির এর ব্যাতিক্রম। সেখানে অষ্টপ্রহর বাদ্য যোগে কীর্তনাদি হয় ও চৌষট্টি মোহান্ত গণের তিরোভাব দিবসে বহুবাদ্যাদি সহযোগে সূচক কীর্তন সহ মন্দির পরিক্রমা হয়ে থাকে।
শঙ্করাচার্য্যের গোবর্ধন মঠের মঠাধীশ এর নির্দেশিত বিধি বিধান অনুসারেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রীতি নীতি পরিচালিত হয়। কিন্তু শ্রীমন্দিরের মধ্যে কোথাও শঙ্করাচার্য্যের কোন মূর্তি দেখা যায়না।
স্থানীয় বিশেষ সমৃদ্ধশালী শ্রীরামানুজ সম্প্রদায়ের মঠসমূহের অধ্যক্ষগণ বহু লক্ষ মুদ্রা ব্যায় করে শ্রীমন্দিরের উত্তরদিকে শ্রীলক্ষ্মীমন্দিরের সামনে যে কুন্ডে শ্রীজগন্নাথ দেবের চরণোদক পতিত হয় তার কাছে একটি উচ্চবেদীতে আচার্য্য রামানুজাচার্য্যের শ্রীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
সমৃদ্ধশালী মঠসমূহের প্রবলপ্রতাপ, অর্থের আকর্ষণ কোনো কিছুই রাজা বা জগন্নাথদেবের সেবকদের বশীভূত করতে পারেনি। তদানীন্তন পুরীর রাজা জানিয়েছিলেন “যদি এই কূর্মবেড়ের মধ্যে কোনো সম্প্রদায় বিশেষের আচার্য্যের নতুন মূর্ত্তি স্থাপনে প্রয়াসী হন তাহলে আপনাদের কপালের তিলক লুপ্ত হইবে" অথচ এই কূর্মবেড়ের মধ্যে অনেকগুলি মন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গের বিগ্রহ ও পাদপদ্ম নির্বিবাদে পূজিত হচ্ছে।
উড়িয়া ভাগবতের রচয়িতা পঞ্চসখার অন্যতম জগন্নাথ দাস ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক। বর্তমান এ অনেক পান্ডারা তার পরম্পরায় দীক্ষিত। তিনি বট গণেশের সামনে বসে ভাগবত পাঠ করতেন। সেখানে বা শ্রীমন্দিরের অন্য কোথাও তার ও কোনো বিগ্রহ বা কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের সময় থেকে শ্রীমুকুন্দদেব পর্যন্ত সকলেই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের থেকে দীক্ষিত ছিলেন। তারা সকলেই গৌরাঙ্গ ও রাধাকৃষ্ণের উপাসক ছিলেন।
১২৫৮ বঙ্গাব্দে মহারাজ রামচন্দ্রদেবের সময় থেকে পুরীর রাজবংশ এমার মঠের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।