গৌরাঙ্গগণোদ্দেশ দীপিকা
শ্রীবলরাম দাস বিরচিত
(বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুথী নং ১৬৫৬)
পুঁথির বিবরণ:-
শ্রীশ্রীরাধাবিনােদৌ বিজয়েতাম
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দ চন্দ্র জয়তি ।
বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দৌ সহােদিতৌ ।
গৌড়ােদয়ে পুষ্পবন্তৌ চিত্রৌসন্দৌ তমনুদৌ ।।
অষ্টাঙ্গ প্রণতি করি বন্দোগুরুপদ ।
যাহার স্মরণে বিঘ্ন না রহে আপদ ।।
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত ঠাকুর ।
যার প্রেমানন্দে পূর্ণ হৈল তিনপুর ।।
দ্বাদশ গােপাল বন্দো আনন্দিত হঞা ।
চৌষট্টি মহান্ত বন্দো মিনতি করিঞা।।
সনাতন বন্দো শ্রীরূপ মহাশয় ।
রঘুনাথ দাস বন্দো করিয়া বিনয় ।।
বৈষ্ণব চরণ বন্দো হয়া সানন্দিত ।
চৈতন্য গণোদ্দেশ কহিব কিঞ্চিৎ ।
অতি পূর্ব পূর্ব আদ্য যে কিছু বিধান ।
কিঞ্চিৎ কিঞ্চিতাভাষ কহিব আখ্যান ।
গ্রন্থ অনুযায়ী যে পাইয়াছি যেইখানে ।
যেখানে যে শুনিয়াছি সাধুর বচনে ।।
প্রথমেতে ভাগবতামৃত গ্রন্থ পাইয়া ।
অতি পূৰ্ব্ব কথা কিছু কহি বিবরিয়া ॥
আর যথা যেই গ্রন্থে পাইয়াছি উদ্দেশ ।
তার অনুভবে কহি গ্রন্থ গণোদ্দেশ ।।
ঐশ্বর্য্য মাধুৰ্য সব লীলার লক্ষণ ।
বিভাগ করিয়া তাহা কহি বিবরণ।।
তবে কহোঁ গণ পরিবার যত হয় ।
কিঞ্চিৎ প্রমাণে তাহা করিব নির্ণয় ।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবত কথাহিয়াং ।
শ্রীভাগবত নিন্দিত সৰ্ব্ব আধান্য মন্যা ।
পেক্ষাহমহৈশ্বৰ্য্য সমাধুৰ্য শ্রীকৃষ্ণয়ে স্বয়ং ।
রূপত্বতস্য শ্রীকৃষ্ণস্য প্রায় শূন্য শক্তি ।
ধারয়িত্বা সং তস্য বিলাসো যথা ॥
বৈকুণ্ঠনাথঽ তষ্যন্মূলশক্তি ধারিয়স্বশ্যাং ।
স জন্ম মহশ্য কুৰ্ম্মাদিকঃ যত্র একৈকশক্তি ।।
সঞ্চার মাত্রংস যাবেশ যথা পৃথােদয় ইতি ।
কৃষ্ণের বিলাসরূপ বৈকুণ্ঠের নাথ ।
মহৈশ্বৰ্য্য ঐশ্বর্য্যের যাহাতে বিখ্যাত ।।
মহৈশ্বৰ্য্য অংশ আদি জানিহ নিশ্চিতে ।
ঐশ্বৰ্য্য লীলা খ্যাতি আবেশাদি হৈতে ।।
ঐশ্বৰ্য্য মহৈশ্বৰ্য্য ইহাতে বিস্তার ।
মাধুৰ্য সে ব্ৰজের কহিব তত্বসার ।।
দ্রোণ নামে নাম শ্রেষ্ঠ আছিল পূর্বেতে ।
ধরা নামে তার জায়া কহিল সাক্ষাতে ॥
সেই ধরা হয় মায়ে দুইত প্রকার ।
রােহিনী হয়েন এক যশােমতি আর ।।
যশােদার গর্ভোদ্ভব শ্রীকৃষ্ণ সুন্দর ।
মাধুর্যের নাথ নিত্যসিদ্ধ কলেবর ।।
ব্রহ্মা প্রতি নারদ করেন নিবেদন।
দৈবকীনন্দন কৃষ্ণ রহিছে কারণ ।।
দৈবকী তনয় কৃষ্ণ বিখ্যাত সংসারে ।
বিশ্বের ভাবনা বস্তু কহাও যাহারে ।।
পুনর্বার যশােদার কহয়ে তনয় ।
কেমনে ভাবিব চিত্তে এ বড় সংশয় ।।
ব্রহ্মা উবাচ
সায়ম্ভব মন্বন্তরাবতার মধ্য গতে ।
সুতপা নামেতে মাের পুত্র সে জগতে ।।
তার জায়া পৃশ্নি নাম বড় ভাগ্যবতী ।
দারুণ তপস্যা দোঁহে কৈলা মহামতি ।
তার তপস্যায় তুষ্ট প্রভু গদাধর ।।
প্রত্যক্ষ হইলা দুই জনা বরাবর ॥
লক্ষ্মী সরস্বতী কান্ত পীত বস্ত্র পরি।
চতুর্ভূজ শঙ্খ চক্র - গদা - পদ্মধারী ॥
তার অবতারণতে সুতপা মহাশয় ।
বাসুদেব নাম তার শুন মহাশয়।।
পৃষ্ণী হৈলা দৈবকী দেবক নন্দিনী ।
তার গর্ভোদ্ভব কৃষ্ণ হইলা আপনি ।।
যেইরূপ পূৰ্বেতে দেখিলা দুইজন ।
সেইরূপ গর্ভোদ্ভব হৈলা সনাতন।।
সৰ্ব্বদা দ্বিভুজ কৃষ্ণ চতুর্ভূজ নন ।
বৃন্দাবন ত্যাজি কাঁহা না করে গমন ।।
দ্বিভুজ স্বরূপে যশােদার গর্ভোদ্ভব ।
আর যত দেখ তার অংশ কলা সব।।
তথাহি
এতে চাংশ কলা পুংশ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং।।
ইতি ভাঃ ১/৩/২৮
দ্বিভূজের অংশ চতুর্ভুজ বিবরণ ।
সেই চতুর্ভুজ হন দৈবকীনন্দন ।।
বসুদেব সেইরূপ আনিল গােকুলে ।
দ্বিভুজ স্বরূপে চতুর্ভুজ আসি মিলে ।।
মৃত্যুঞ্জয় নাম সদাশিব নিত্যরূপ ।
তার নিজ জায়া হৈলা কন্যার স্বরূপ ৷।
সেই কন্যা লয়া বসুদেবের গমন ।
আপন ভবনে আসি দিলা দরশন ।।
তথাহি সন্দর্ভকারিকায়াং
দ্রোণস্তু নন্দভবিতা বস্তুন প্রবরৌমুনে ।।
ধারয়া যশােদা তা সায়া জাত পুত্র ভগবান হরিঃ।
নারদৌবাচ—
দেবকী তনয় প্রক্তো ভগবান বিশ্বভাবেন ।
পুনঃ যশােদা তনয়ং ব্রহ্ম নারদ শিষ্য প্রদান ॥
ব্ৰহ্মাউবাচ
স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে চৈব সুতপা নাম মত শুভ ।
ভাৰ্য্যায়াসহ পৃষ্ঠ যে অপতিঽপতি দারুনঃ ।
তরস্তু তপস্যা স্তষ্ট অত্যক্ষ ভবিতা হরে।।
লক্ষ্মী সরস্বতী কান্ত পীতবাস চতুর্ভূজ ।।
শঙ্খ - চক্র - গদা - পদ্ম মালাধারি বিধি বিনােচনং।
সর্বদা দ্বিভূজ কৃষ্ণা ন কদাচ চতুর্ভূজঃ ।
বৃন্দাবন পরিত্যাজ্য কদাচিৎ নৈব গচ্ছতি।।
স এব বসুদেব সুত ভবিষ্যতি চতুর্ভুজঃ ।
শঙ্খচক্রগদা পদ্ম বিভ্রতি কৌস্তুভ ভূষিতঞ্চ ।।
পূরা বৃন্দাবনে নিত্যোস্থিতি সদাশিব।
তৎ জায়া ভবতি থাসাং জনােদায়ননী হরে ।
ইতি প্রথম ব্যুহ ।।
অথ দ্বিতীয় ব্যুহ কথ্যতে ।।
গােলকনাথস্থ দ্বিতীয় ব্যুহ যােবলদেবস্য
বিলাসো মহাবৈকুণ্ঠ সঙ্কর্ষণঃ ।
তাষাং শকার নাথব সই তস্য মহৈশ্বৰ্য্য ।
ঐশ্বৰ্য্য ইতিঃ।
অথ বল দেবস্য মাধুৰ্য্য সন্দর্ভ কারিকায়াঃ।
কদাচিত গােবিন্দয়া সাশ্ব্যাযুত বিক্রমাচ ।।
বিজই গুবনে রাসাে সঙ্গে চ ব্রজ যসিতা ।
যা লীলা লোক এবৰ্ত্ত সা লীলা মাধুৰ্য্য ।।
লোক নামধিয়া লীলা সা লীলা ঐশ্বৰ্য্যঃ
ঈশ্বরে মান যে চৈব প্রকাশে ন চ সম্ভবঞ্চ
ইতি চিন্তামনি কৃত যােগমায়া সুপাশ্বিতো
মন্ত্র চিন্তামণিশ্চৈব চিন্তামনি ফলপ্রদং ইতি ॥
বিন্ধারসে নৈব বমতি ঈণমা* যথা ইতি ।
ব্রজলীলা মাধুৰ্য্য সে রসের কারণ ।
রাগানুগভক্ত যাহা কৈল আস্বাদন ।
যেই লীলা লােকত্তর মাধুৰ্য্য হয়েন ।
লোকাধিক লীলা এই ঐশ্বর্য্য কহেন ।।
মধুপুর লীলা তার দ্বারাবতী স্থান ।
মাধুর্য্য ঐশ্বর্য্য মিশ্রা শাস্ত্রের প্রমান।।
মহা বৈকুণ্ঠ আদি বৈভব অপার ।
কৃষ্ণের ঐশ্বর্য্য লীলা যাহাতে বিস্তার ।
মাধুৰ্য্য আস্বাদিতে কৃষ্ণ শ্রীনন্দনন্দন ।
ভাবিয়া তাহার কিছু কহো বিররণ।।
যেই কৃষ্ণ সেইত চৈতন্য নিজরূপ ।
মহা মাধুৰ্য্য আস্বাদিতে কৈল নবদ্বীপ ।।
সর্ব অবতার সার চৈতন্য গােসাঞি ।
অংশ কলা আসি সব তাহাতে মিশাই ।।
আবেশ বৈভব আর প্রভব বিহিত ।
পরাবস্থা আদি সব চৈতন্য মিশ্রিত ।।
সর্ব অবতার ভক্ত হয়া একত্তর ।
আসিয়া মিলিলা সব চৈতন্য বরাবর ।
শ্বেত পীত আদি প্রভু বহু অবতার ।
কল্পকল্পান্তর ভক্ত সংহতি যাহার ।।
যার যেইভাব তাহা দেখান অনেক ।
রুক্মিনীর ভাব কেহ দেখে পরতেক ।।
সত্যভামার ভাব কেহ দেখে আনন্দিত।
যার যেই দেখে ভাব ভাবনা বিহিত ।।
মৎস্য কুৰ্ম্ম উপাসনা আছিলা পূৰ্ব্বেতে ।
সেই ভাব দেখে সেই চৈতন্য অঙ্গেতে ।।
নদীয়ার যুবতী দেখে কন্দর্প স্বরূপ ।
তার্কিক পাষণ্ডী দেখে বিরাটের রূপ ।।
শ্রীরাম স্বরূপ কেহো দেখয়ে নয়ানে ।
ষড়ভূজ স্বরূপ কেহো দেখয়ে বিদ্যমানে ।
এইরূপে নানা লীলা দেখে ভক্তগণ ।
পূর্বে যার যেই ছিল ভাবনা ভজন ।।
সর্বে আসি চৈতন্য দেখয়ে কুতুহলে ।
চৈতন্যের ভাবে সবে আনন্দে বিহারে ।
জন্মে জন্মে যেইজন পূর্ণবন্ত হয়া ।
নানা অবতারাদি যত মিলায় আসিয়া ।।
সেই সব পূণ্যবন্ত চৈতণ্য অবতারে ।
আদি ভেদে সভে রাধাকৃষ্ণ মেলে ।
তথাহি - ভাগবতে
শ্বেত দ্বীপাদি রূপাণং মীন - কুৰ্ম্মমুপাসিত ।
শত জন্মানি পুর্ণানি রতি স্যাৎ শ্যামসুন্দরে।।
সাঙ্গ - পাঙ্গ পরিষদ লইয়া বিহার ।
কল্পকল্পান্তর ভক্ত পাইল নিস্তার ।
গোকুল বিহারী কৃষ্ণ হন অবতারী ।
সর্বরূপ ধৃত সর্বময় অধিকারী ।
গােপীগণে দেখাইলা শ্রীরামরূপ ।।
সেতুবন্ধ দেখাইল অতি অপরূপ।
আনন্দিত সেতুবন্ধ দেখি গােপীগণে।
রঘুনাথ রূপ দেখাইল কাম্য বনে ॥
গােপীগণ নিবেদন কৃষ্ণ প্রতি বলে ।
ক্ষীরােদ সমুদ্রশায়ী কিরূপে আছিলে।।
সেরূপ দেখি ত ইচ্ছা হয় সবাকার ।
লক্ষ্মীপদ সেবা কৃত কিরূপ তােমার ।।
নাভি পদ্মে ব্ৰহ্মোদ্ভব হইলা কেমনে ।
কৃপা করি দর্শন করাবে গােপীগণে।।
অবতারী তারি নাম নানা রূপ হয় ।
অবতারে এত শক্তি কোন কালে নয়।।
লীলা অবতার ব্রহ্মার প্রতি দিনে হয় ।
চৈতন্য অবতার ব্রহ্মার প্রতি দিনে নয় ।।
মহাঅবতারি হন চৈতন্য গােসাঞি ।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সম ব্ৰক্ষাগুতে নাঞি ।।
অবতারি মহা অবতারের বিচার ।
যাহাতে মিশ্রিত হৈল সর্ব্ব অবতার।।
অতএব বেদাদি না জানে কারণ ।
ঐশ্বৰ্য্য মাধুৰ্য্য দুই আশ্রয় লক্ষণ।।
গণ বিভাের তাহা কহিব কিঞ্চিত ।
কহিব কারণ তাহা যে হয় উচিত ।।
তথাহি—
কৃষ্ণবর্ণ ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গপাঙ্গাস্ত্র পার্ষদং ।
যজ্ঞৈ সঙ্কীর্তণে প্রায়ৈর্যজন্তিহি সুমেধসঃ।।
অথ ঐশ্বর্য্য মাধুৰ্য আশ্রয় ॥ ৪
মহামাধুর্য্যের রূপ রাধা ঠাকুরাণী ।
গদাধর নাম ইবে কহিল বাখানী ।।
মাধুর্য্যের অংশে চন্দ্রাবলী নাম হন ।
সদাশিব কবিরাজ জানিহ কারণ ।।
মহা ঐশ্বৰ্য্যার হয় দুই নামা ।
রুক্মিনী হয়েন এক আর সত্যভামা ।
মহৈশ্বৰ্য্য যুক্ত নামা রুক্মিনী পূৰ্ব্বেতে ।
অদ্য লক্ষ্মী ঠাকুরাণী কহিল সাক্ষাতে।।
পূৰ্ব্বে সত্যভামা নাম আছিলা যেমন ।
ঠাকুরাণী বিষ্ণুপ্রিয়া জানিহ কারণ ॥
ঐশ্বৰ্য্য যুক্ত পূর্বে যে লক্ষ্মী হয়েন ।
লক্ষ্মীগদাধর নাম প্রমাণ কহেন ।
অথ নিত্যানন্দ ঐশ্বৰ্য্য মাধুৰ্য্যতি ।।
বলরাম পূর্বে যে আছিলা হলধর ।
ইবে নিত্যানন্দ সেই অবধুত কলেবর ।
পূর্বে যে আছিলা বলরামের নিজ শক্তি ।
মহা মহামাধুর্য্যে সে মাধুৰ্য্য অধিপতি ।
জাহ্নবা গােসাঞি তাঁর অদ্য নাম হয় ।
মাধুৰ্য্য প্রকাশ যাহা বিনু কভু নয় ।।