১০৮ উপনিষদ বৈষ্ণব ভাষ্য
শুকরহস্য উপনিষদ
অনুবাদ:- এখন চার মহাবাক্য বলা হচ্ছে। ওঁ প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম। ওঁ অহং ব্রহ্মাস্মি। ওঁ তত্ত্বমসি। ওঁ অয়মাত্মা ব্রহ্ম।। এইগুলির মধ্যে তত্ত্বমসি মহাবাক্য ব্রহ্ম ও জীবের অভেদ বাচকতা প্রতিপাদন করে। যে সাধক এই বাক্যের জপ করে তিনি পরমমঙ্গলময় ভগবান সাথে সাযুজ্য মুক্তি লাভ করেন।
তাৎপর্য্য
বেদ এর মহাবাক্য হচ্ছে প্রণব বা ওঁকার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও বলেছেন—
প্রণব যে মহাবাক্য ঈশ্বরের মূর্ত্তি
প্রণব হৈতে সর্ব্ববেদ জগতে উৎপত্তি।।
তত্ত্বমসি জীব হেতু প্রাদেশিক বাক্য।
প্রণব না মানি তারে কহে মহাবাক্য।।
মধ্য/৬/১৭৪-১৭৫
যথা প্রমাণ—
ওমিতি ব্রহ্ম। তৈত্তীরীয় উপনিষদ ১/৮/১
ওঁ ই ব্রহ্ম
এতদ্ ওমিতি এবাক্ষরং ত্রয়ী বিদ্যা (জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণ ১/১৮/১০)
অনুবাদ:- ওঁকার ই তিন বেদ বিদ্যার সাররূপ।
এই সকল প্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে বেদের মহাবাক্য ওঁ। তবে এই উপনিষদে কেন তত্ত্বমসি ইত্যাদি চারটি বাক্যকে মহাবাক্য বলা হয়েছে? কোনো শ্রুতিবাক্যের তাৎপর্য্য তার উপক্রম, উপসংহার, অভ্যাস ইত্যাদি দ্বারা নির্ণয় করতে হয়।
এখন এই উপনিষদ মন্ত্রের উপক্রম এই ভাবে হয়েছে—শ্রীশুকদেব প্রশ্ন করেছেন তত্ত্বমসি ইত্যাদি বাক্যের ষড়ঙ্গন্যাস সহ রহস্য জানতে ইচ্ছা করি।
দেবাদিদেব সর্বজ্ঞ সচ্চিদানন্দলক্ষণ।
উমারমণ ভূতেশ প্রসীদ করূণানিধে।।
উপদিষ্টং পরংব্রহ্ম প্রণবান্তর্গতং পরম্।
তত্ত্বমস্যাদি বাক্যানাং প্রজ্ঞাদীনাং বিশেষতঃ।।
শ্রোতুমিচ্ছামি তত্ত্বেন ষড়ঙ্গানি যথাক্রমম্।
বক্তব্যানি রহস্যানি কৃপয়াদ্য সদাশিব।। ১১-১৩
অনুবাদ:- হে দেবতাদের আদিদেব হে সর্বজ্ঞ, হে সচ্চিদানন্দ স্বরূপ, উমাপতি, করুণানিধি, সকল জীবের প্রতি কৃপাশীল, আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। আপনি আমায় প্রণব এর স্বরূপ ও তার দ্বারা পরব্রহ্মের উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমি বিশেষ রূপে তত্ত্বমসি, প্রজ্ঞানংব্রহ্ম, ইত্যাদি মহাবাক্য এর তত্ত্ব, ষড়ঙ্গন্যাস ক্রমপূর্বক শোনার ইচ্ছা করি। হে সদাশিব আপনি কৃপা করে এসকল রহস্য আমার কাছে প্রকট করুন।
তার উত্তরে মহাদেব তাকে বলেছেন “অথ মহাবাক্যানি চত্বারি।" (শুকরহস্য উপনিষদ ২২)
শ্রীশুকদেব বেদের মহাবাক্য জানতে চাননি তিনি বিশেষ করে বলেছেন তত্ত্বমসি ইত্যাদি বাক্য সম্বন্ধে জানতে চাই। মীমাংসা শাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে কোনো বাক্যে বিশেষ রূপে প্রশ্নের বিশেষ উত্তর সাধারন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। একটি উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি যদি প্রশ্ন হয় উজ্জয়িনীর রাজা র মাহাত্ম্য বলুন? তার উত্তরে যদি বলা হয় বিক্রমাদিত্য একচ্ছত্র সম্রাট, তিনি সসাগরা ভূমন্ডলের অধিপতি। তবে তার দ্বারা বিক্রমাদিত্য উজ্জিয়িনী র অধীনস্থ সাগর ভূমন্ডলের ই অধিপতি হন। সমস্ত পৃথিবীর নয়। অন্য বাক্য গুলি তার প্রশংসাসূচক বাক্য বা অর্থবাদ।
আর দ্বিতীয়ত এই বাক্য গুলিকে বেদ এর মহাবাক্য ধরা হলে তা আগে দেখানো প্রমাণের বিরোধী হয়। তাই এখানে মহাবাক্য পদ অর্থবাদ রূপে বুঝতে হবে। তা এই সকল বাক্যের মাহাত্ম্য অধিক রূপে বর্দ্ধনের জন্য এই শ্রুতিতে তাকে মহাবাক্য বলা হয়েছে। এই প্রকার ব্যাখ্যা না করলে মূল শ্রুতির সাথে ও প্রধান উপনিষদ গুলির সাথে বিরোধ হয়।
অর্থবাদ কাকে বলে সেই প্রসঙ্গে জৈমিনী ঋষি পূর্বমীমাংসায় বলেছেন বেদ এর যেসকল বাক্য ক্রিয়া প্রতিপাদন করে সেগুলি বিধি ও যেসকল বাক্য বিধির প্রশংসা করে সেগুলি অর্থবাদ। যেমন ভাষ্যকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন
বায়ব্যাং শ্বেতমালভেত ভূতিকামো বায়ুর্ব্বৈ ক্ষেপিষ্ঠা দেবতা।
তৈত্তীরীয় সংহিতা ২/১/১/
ঐশ্বর্য্যকামী ব্যাক্তি বায়ু দেবতার জন্য শ্বেতবর্ণ পশু সংগ্রহ করবে। বায়ু ক্ষিপ্রগামী দেবতা।
এখানে বায়ুর জন্য শ্বেতবর্ণ পশু সংগ্রহ করবে এটি বিধি। ও বায়ুর্ব্বৈ ক্ষেপিষ্ঠা দেবতা অর্থাৎ বায়ু ক্ষিপ্রগামী দেবতা এটি অর্থবাদ বাক্য বা প্রশংসা বাক্য মাত্র।
সেরকম এখানে পরবর্তী মন্ত্র গুলিতেও এই শুকরহস্য উপনিষদে তত্ত্বমসি ইত্যাদি বাক্যের ন্যাস ও জপের বিধি বলা হয়েছে। তাই এখানে মহাবাক্য বলতে মন্ত্রের প্রশংসাবোধক অর্থবাদ ই বুঝতে হবে সমস্ত বেদের মহাবাক্য নয়।
এই চারটি বাক্যের অর্থ পরবর্তী মন্ত্রের তাৎপর্য্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তত্ত্বমসি বাক্যের অর্থ তুমি ব্রহ্মের। এখানে ব্রহ্ম ও জীবের অভেদ বোঝানো হয় বলতে বলা হয়েছে জীব ব্রহ্মের শক্তি। তাই শক্তি শক্তিমান অভেদত্ব এর কথা এখানে বলা হচ্ছে। অদ্বৈতবাদীদের মতো ব্যাখ্যা তুমিই ব্রহ্ম এই রূপ অভেদ দেখানো হলে তা মূল শ্রুতি ও প্রধান উপনিষদ সমূহের অর্থের সাথে বিরোধ হয়। শ্রীমধ্বাচার্য্য বহু শ্রুতি মন্ত্র দ্বারা জীব ও ব্রহ্মের ভেদ এর কথা দেখিয়েছেন সেগুলি এক্ষেত্রে বিচার্য্য।
ন্যায়ামৃত গ্রন্থে শ্রী ব্যাসতীর্থ ও এই বাক্য গুলিকে মহাবাক্য বলাকে অর্থবাদ বলেছেন।
ন্যায়ামৃত প্রথম পরিচ্ছেদ দ্বিতীয়ভাগ ৩য় অনুচ্ছেদ সামান্যেন মিথ্যাত্বশ্রুতিনিরাস্ এ দ্রষ্টব্য। কেশবাচার্য্য পান্ডুরঙ্গী সংস্করণ