Vallabhacharya and Chaitanya Mahaprabhu
চৈতন্যচরিতামৃতেও রথযাত্রার সময়ে পুরীতে বল্লভাচার্য্যের সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর সাক্ষাতের বর্ণনা আছে।
রথযাত্রা দিনে প্রভু কীর্ত্তন আরম্ভিলা ।।
পূৰ্ব্ববৎ সাত সম্প্রদায় পৃথক্ করিলা ॥ ৭০ ॥
অদ্বৈত , নিত্যানন্দ , হরিদাস , বক্রেশ্বর ।
শ্রীবাস , রাঘব , পণ্ডিত - গদাধর ৷৷ ৭১ ৷৷
সাত জন সাত ঠাঞি করেন কীর্ত্তন ।
‘হরিবোল ’ বলি ’ প্রভু করেন ভ্রমণ ৷৷ ৭২ ৷৷
চৌদ্দ মাদল বাজে উচ্চ সঙ্কীৰ্ত্তন ।
এক এক নর্ত্তকের প্রেমে ভাসিল ভুবন ॥ ৭৩ ৷৷
দেখি ’ বল্লভভট্টের হৈল চমৎকার ।
আনন্দে বিহ্বল , নাহি আপন সান্তাল ॥ ৭৪ ॥
তবে মহাপ্রভু সবার নৃত্য রাখিল ।
প্রভুর চরিত্রে ভট্টের চমৎকার হৈল ॥ ৭৫ ॥
চৈ.চ অন্ত্য/৭/৭০-৭৫
তাই এখানে উল্লিখিত বল্লভ ভট্ট পুষ্টিমার্গ প্রতিষ্ঠাতা মহাপ্রভূ শ্রী বল্লভাচার্য্য ই।
বল্লভাচার্য্য কি গৌড়ীয় সম্প্রদায় থেকে কিশোরী গোপাল মন্ত্র নিয়ে ছিলেন?
শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে
বল্লভ ভট্টের হয় বাৎসল্য উপাসন ।
বালগোপাল - মন্ত্রে তিহো করেন সেবন ৷৷ ১৪৪ ৷৷
পণ্ডিতের সনে তার মন ফিরি গেল।
কিশোর গোপাল উপাসনায় মন দিল ১৪৫ ৷৷
পণ্ডিতের ঠাঞি চাহে মন্ত্রাদি শিখিতে ৷
পণ্ডিত কহে ,এই কৰ্ম্ম নহে আমা হৈতে ৷৷১৪৬ ৷৷
আমি পরতন্ত্র , আমার প্রভু গৌরচন্দ্র ।
তার আজ্ঞা বিনা আমি না হই ‘ স্বতন্ত্ৰ ’ ৷ ১৪৭ ৷৷
…………..…………………………...
দিনান্তরে পণ্ডিত কৈল প্রভুর নিমন্ত্রণ ।
প্রভু তাঁহা ভিক্ষা কৈল লঞা ভক্তগণ ॥ ১৬৬ ৷৷
তাঁহাই বল্লভ ভট্ট প্রভুর আজ্ঞা লৈল ।
পণ্ডিত - ঠাঞি পূৰ্ব্বপ্রাৰ্থিত সব সিদ্ধি হৈল ॥১৬৭
(চৈ.চ/অন্ত/৭/১৪৪-১৪৭)যদুনাথ গোস্বামী রচিত বল্লভ দিগ্বিজয় গ্রন্থে বর্ণনা আছে—
অথালর্কপুরে নিবসদ্ভির্ভগবদাজ্ঞাতো দশমসুবোধিনী পূরিতা। একাদশে সমারব্ধা। মাতৃচরণেভ্যো বৃত্তং জ্ঞাপিতম্। তত স্তৃতীয়াজ্ঞা জাতা। ততঃ সভায়াং মাতৃচরণেভ্য উপদেশো দত্তঃ সন্ন্যাসনার্থনা চ কৃতা।….. ততো মাধ্বসম্প্রদায়ী বিষ্ণুস্বামিমতানুযাযী ভগবদ্নুগৃহীতো মাধবেন্দ্রযতিঃ সমাগতঃ। তস্য প্রশংসাদি বিধায় নিবাসিতঃ।…..তন্মুখাৎসন্ন্যাসধর্মাঃ শ্রাবিতাঃ।…. তত্র যতিমাধবেন প্রেষো দর্শিতঃ । পূর্ণানন্দেতি নাম চ কৃতম্ । কুটীচকাশ্রমং গৃহীত্বা কাষাযাম্বরা স্ত্রিদণ্ডধারিণঃ শিখাসুত্রযজ্ঞোপবীতবন্তঃ
অনুবাদ:- “শ্রীবল্লভাচার্য্য অলর্কপুর বা অড়ৈল গ্রামে ভাগবত একাদশ স্কন্দ সুবোধিনী সম্পূর্ণ করে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা করেন। ও তার জ্যোষ্ঠ পুত্র গোপীনাথজী প্রভূচরণ কে আচার্য্য সিংহাসনে বসিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই সময় মাধ্বসম্প্রদায়ী ও বিষ্ণুস্বামী মতানুযায়ী মাধবেন্দ্রযতি উপস্থিত হন।…. তারপর গোপীনাথজীর হাত থেকে ভাগবত সন্ন্যাস পদ্ধতি দেখিয়ে সেই অনুসারে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। মাধবেন্দ্র যতি তার পূর্ণানন্দ নাম রাখেন। আচার্য্য কূটীচক আশ্রম গ্রহণ করে কাষায়বস্ত্র ও ত্রিদন্ড, শিখা, যজ্ঞোপবীত ধারণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।"
সন্ন্যাস গ্রহণের অল্প কিছুদিন পর ১৫৮৭ বিক্রম সম্বতে কাশীতে বল্লভাচার্য্য অপ্রকট হন।
১৫৮৭ বিক্রম সম্বতে (১৫৩০ খৃঃ এ) বল্লভাচার্য্য মহাপ্রভু অপ্রকট হয়েছিলেন। বল্লভাচার্য্যের অপ্রকটের সময়কালে মাধবেন্দ্রপুরীর প্রকট থাকা সম্ভব নয়। মাধবেন্দ্রপুরীর সম্প্রদায়ী কোনো সন্ন্যাসী হওয়াই সম্ভব। (কারন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ তার সন্ন্যাস গ্রহণের ও পূর্বে শ্রীঈশ্বরপুরীপাদের কাছে তার পরমগুরু মাধবেন্দ্র পুরীর অপ্রকটের কথা শুনেছিলেন।)
মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরীর সাক্ষাৎ শিষ্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও পুন্ডরীক বিদ্যানিধি এর (ইনিও মাধবেন্দ্র পুরীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন) শিষ্য গদাধর পন্ডিত গোস্বামী ছাড়া আর কোনো সন্ন্যাসী শিষ্যের কথা জানা যায় না। মহাপ্রভু একদন্ডী সন্ন্যাসী হলেও গদাধর পন্ডিত গোস্বামী ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসী ছিলেন। (বর্তমানে ইসকনে যে সন্ন্যাস দেখা যায় শিখা, যজ্ঞোপবীত, ত্রিদন্ড ধারণ সহ সন্ন্যাস গ্রহণ) তাই শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে যে উল্লেখ আছে বল্লভাচার্য্য গদাধর পন্ডিত গোস্বামীর কাছে কিশোর গোপাল মন্ত্র নেন তা অস্বীকার করার যথেষ্ট কারন পাওয়া যায় না।
পুষ্টিমার্গীয় সম্প্রদায় প্রদীপ গ্রন্থ থেকে জানা যায় বল্লভাচার্য্য যখন প্রয়াগের কাছে অলর্কপুর বা অড়ৈল গ্রামের নিজ গৃহে অবস্থান করছিলেন তখন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু কে সেখানে নিয়ে আসেন। সেই সময় বল্লভাচার্য্য তার পত্নীকে শীঘ্র অনিবেদিত অন্ন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেবার জন্য দিতে বলেন। তাতে তার স্ত্রী আশ্চর্য্য হন। কারন বৈষ্ণব তার উপর সন্ন্যাসী কখনোই বিষ্ণুকে অনিবেদিত অন্ন গ্রহণ করেননা। তবে কেন শ্রীবল্লভাচার্য্য এই অশাস্ত্রীয় উক্তি করলেন? তাতে বল্লভাচার্য্য বলেন তার হৃদয়ে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণকেই ভোগ নিবেদন করবো বলে।
একদা পূর্ব গঙ্গাতীরে বসতঃ শ্রীবল্লভস্য গৃহে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যৈঃ সমাগতম্ । তমদৃষ্টপূর্বং দৃষ্ট্বা শ্রীবল্লভেনোক্তম্— ইমে কৃষ্ণচৈতন্যাঃ, ইত্যুক্ত্বা নমস্কৃতাঃ। তৎসময়ে মধ্যাহ্ন ভোগানন্তরং ভগবতি শযনং গতে সতি স্বধর্মপত্নীং শ্রীবল্লভোঽব্রবীৎ– ভোঃ ! মদাজ্ঞয়া ত্বমস্মৈ সুপকমন্নং ভোজয়। পত্নী প্রাহ – অনিবেদিতং কথং দেয়ম্ ? তদা শ্রীবল্লভেনোক্তম্ – দেযমেব, অস্য হৃদয়স্থঃ শ্রীকৃষ্ণো ভোক্ষ্যত্যেব ।
(সম্প্রদায় প্রদীপ চতুর্থ প্রকরণ)
বৈষ্ণবরা কখনোই অনিবেদিত অন্ন ভোজন করেনা। বল্লভাচার্য্য চৈতন্য মহাপ্রভূকে ঈশ্বর জেনেই তাকে অনিবেদিত অন্ন ভোগ নিবেদন করেন।
তাই বল্লভাচার্য্য ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কে পরবর্তী কালে ঈশ্বর রূপে স্বীকার করেন।
চৈতন্যচরিতামৃতে ও এই কাহিনী বর্ণনা আছে—
ত্রিবেণী উপর প্রভুর বাসা ঘর স্থান ।
দুইভাই বাসা কৈল প্রভু সন্নিধান ॥ ৬০ ॥
সেকালে বল্লভভট্ট রহে আড়াইল গ্রামে ।
মহাপ্রভু আইলা ’ শুনি ’ আইল তাঁর স্থানে ॥৬১
………………………………………….
তবে ভট্ট মহাপ্রভুরে নিমন্ত্রণ কৈলা ।
মহাপ্রভু দুইভাই তাঁহারে মিলাইলা ॥ ৬৫ ॥
………………………………………….
সগণে প্রভুরে ভট্ট নৌকাতে চড়াঞা ।
ভিক্ষা দিতে নিজ ঘরে চলিলা লঞা ॥ ৭৭
………………………………………….
নিজ - গৃহে আনিলা প্রভুরে সঙ্গেতে লঞা ॥ ৮৪ ৷৷
আনন্দিত হঞা ভট্ট দিল দিব্যাসন ।
আপনে করিল প্রভুর পাদপ্রক্ষালন ॥ ৮৫ ॥
সবংশে সেই জল মস্তকে ধরিল ।
নূতন কৌপীন - বহির্ব্বাস পরাইল ॥ ৮৬ ॥
গন্ধ পুষ্প ধূপ দীপে মহাপূজা কৈল ।
ভট্টাচার্য্যে মান্য করি ’ পাক করাইল ॥ ৮৭ ॥
ভিক্ষা করাইল প্রভুরে সস্নেহ যতনে ।
রূপগোসাঞি দুইভাইয়ে করাইল ভোজনে ॥৮৮
………………………………………….
দেখি ’ বল্লভ - ভট্ট মনে চমৎকার হৈল ।
দুই পুত্ৰ আনি প্রভুর চরণে পাড়িল ॥ ১০৮
চৈতন্যচরিতামৃত/মধ্য/১৯/৬০-১০৮
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ ১৫৭২ বিক্রম সম্বতে বৃন্দাবন পরিক্রমায় যান। বৃন্দাবন থেকে ফেরার পথে প্রয়াগে আসেন। সেখানে ত্রিবেণী সঙ্গমে বেণীমাধব মন্দিরের কাছে কোনো ব্রাহ্মণ গৃহে অবস্থান করছিলেন। সেখানে রূপ ও অনুপম দুই ভাই শ্রী চৈতন্যমহাপ্রভূর সাথে মিলিত হন। সেইসময় বল্লভাচার্য্য প্রয়াগের অপরপাড়ে অড়ৈল গ্রামে বসবাস করতেন। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভূ কে দর্শন করতে আসেন ও তাকে নিজগৃহে নিমন্ত্রণ করেন। নিজগৃহে দিব্য আসনে বসিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর মহাপূজা করেন। পাদপ্রক্ষালন করে সবংশে চরণামৃত গ্রহণ করেন। ও দুই পুত্র গোপীনাথজী, বিট্ঠলনাথজীকে প্রভূর চরণে নিবেদন করেন। ১৫৭২ সম্বতেই বিট্ঠলনাথের জন্ম হয়। তাই কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বর্ণনা ঐতিহাসিক দিক থেকেও নিঁখুত।