একাদশীতে অনুকল্প প্রসাদের বিধান কোন শাস্ত্রে আছে?

একাদশীতে অনুকল্প প্রসাদের বিধান কোন শাস্ত্রে আছে?




একাদশীতে অনুকল্প প্রসাদ পাওয়ার বিধান আমাদের বৈদিক শাস্ত্রসমূহের মধ্যে বিস্তারিত ভাবে রয়েছে। একাদশীতে উপবাস করার শাস্ত্রীয় বিধান হলো- যাদের সমগ্র দিনরাত নির্জলা উপবাস করার মতো শারীরিক সামর্থ রয়েছে, তারা নির্জলা উপবাস পালন করবেন। কিন্তু কলিহত জীব আমরা, আমাদের সকলের পক্ষে নির্জলা উপবাস করা সম্ভব হয় না। তাই ভগবান কৃপাবশত আমাদের জন্য একাদশীর দিনে অনুকল্প প্রসাদ গ্রহণের বিধান দিয়েছেন বৈদিক শাস্ত্র সমূহে। যারা নির্জলা উপবাস করতে অসমর্থ, শাস্ত্রে তাদের জল পান করে ব্রত করার বিধান দেওয়া হয়েছে, একে বলে সজলা ব্রত। যারা সজলা ব্রত করতেও অসমর্থ, তাদের জন্য ভগবান বিধান দিয়েছেন- কেউ চাইলে ভগবানকে ফল মূল কন্দ সরাসরি কিংবা রান্না করে ভগবানকে নিবেদন করে সে অনুকল্প প্রসাদ পেতে পারেন। একে বলে সফলা ব্রত। তবে কোন মতেই রবিশস্য ভোজন করা যাবে না একাদশীর ব্রতে। একাদশীর দিনে রবিশস্য ভোজন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।


এবার আসুন বৈদিক শাস্ত্র সমূহ হতে দেখে নিই উক্ত বিধির সপক্ষে প্রমাণসমূহ-


১) বেদে সজলা ব্রতের বিধান:


যদনাশ্বানুপবসেৎ ক্ষোধুকঃ স্যাদ্যষ্বীয়াদ্রদ্রোহস্য পশূনভি মন্যেত। অপোহশ্মাতি। তন্নেবাশিতং নেবানশিতং ন ক্ষোধুকো ভবাতি নাস্র রুদ্রঃ পশূনভি মন্যতে। বজ্ৰো বৈ যজ্ঞঃ ক্ষুৎ খলু বৈ মনুষ্যস্য ভ্রাতৃব্যো যদনাশ্বানুপবসতি বজ্রেণৈব সাক্ষাৎক্ষুধং ভ্রাতৃব্যং হন্তি ॥

[কৃষ্ণযজুর্বেদ, ১/৬/১৫]

অনুবাদঃ

উপবাসে ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধাগ্নি জীবের ক্ষতি সাধন করে । যদি ক্ষুধা অসহনীয় হয় তবে জলপান করবে। জলপানে ভোজন হয়, আবার হয়না। যজ্ঞ বজ্রসদৃশ, ক্ষুধা মানুষের শত্রু। না খেয়ে উপবাস করলে যজ্ঞরূপ বজ্র তার ক্ষুধারূপ শত্রুকে বিনাশ করে।


২) সজলা ও সফলা একাদশী ব্রতের বিধান :


ন ভোক্তব্যং ন ভোক্তব্যং ন ভোক্তব্যঞ্চ নারদ।

গৃহিভির্ব্রাহ্মনৈরন্নং সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে ॥ ৮ 

গৃহী শৈবশ্চ শাক্তশ্চ ব্রাহ্মণো জ্ঞানদুর্ব্বলঃ। 

প্রয়াতি কালসূত্রঞ্চ ভুক্ত্বা চ হরিবাসরে ॥ ৯ 

কৃমিভিঃ শালমানৈশ্চ ভক্ষিতস্তত্র তিষ্ঠতি। 

বিণ্মূত্রভোজনং কৃত্বা যাবদিন্দ্ৰাশ্চতুৰ্দ্দশ ॥ ১০ 

জন্মাষ্টমীদিনে চৈব শ্রীরামনবমীদিনে। 

শিবরাত্রৌ চ যো ভুঙেক্ত সোঽপি দ্বিগুণপাতকীয়।।

উপবাসাসমৰ্থশ্চ ফলমূলজলং পিবেৎ। 

নষ্টে শরীরে স ভবেদন্যথা চাত্মঘাতকঃ ॥ ১২ 

সকৃদ্ ভুঙেক্ত হবিষ্যান্নং বিষ্ণোনৈবেদ্যমেব চ।

ন ভবেৎ প্রত্যবায়ী স চোপবাসফলং লভেৎ ॥১৩

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ২৭। ৮-১৩ ]


বঙ্গানুবাদঃ

গৃহী, ব্রাহ্মণ, শৈব, শাক্ত অথবা বৈষ্ণব যাহা কেন হউন না একাদশীতে অন্নাহার করিলে, কালসূত্রে গমন করেন এবং সেই স্থানে শালবৃক্ষ প্রমাণ কৃমিগণকর্তৃক ভক্ষিত ও বিমূত্রভোজী হইয়া চতুর্দ্দশ ইন্দ্র পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করেন। একাদশী ছাড়াও জন্মাষ্টমী, শ্রীরামনবমী ও শিবরাত্রি দিবসে যিনি ভোজন করেন, তিনি ইহা অপেক্ষা দ্বিগুণত্তর পাতকী হন। কিন্তু উপবাস জন্য শরীর নষ্ট হইলে, আত্মহত্যার পাপ হয়, তাই (নির্জলা) উপবাসে অসমর্থ হইলে, ফলমূল ভোজন ও জল পান করিবেন। অথবা একবার বিষ্ণুর নিবেদিত হবিষ্যান্ন ভোজন করিবেন, তাহাতে কিছুমাত্র প্রত্যবায় নাই বরং উপবাসের ফল লাভ করিবেন।


মহাভারতেও বলা আছে-

অষ্টৈতান্যব্ৰতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ। 

হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম।

[ মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৩৯।৭০ ]

বঙ্গানুবাদ:

ফল, মূল, ক্ষীর, ঘৃত, ব্রাহ্মণ কামনা, গুরুর বচন ও ঔষধ এই আটটি ব্রত-নাশক নহে।


অন্নান্ সর্ব্বান বৰ্জ্জয়িত্বা গৌধূমাদ্যাম্নৃপেশ্বর। 

একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহার মুদা নরঃ ॥ 

[ গর্গসংহিতা, অধ্যায় ৬১, শ্লোক- ৫০ ]

বঙ্গানুবাদ:

হে নৃপবর! গোধূমাদি( গম,আটা, ময়দা সহ অন্যান্য) সর্ববিধ অন্ন বর্জন করিয়া মানব একাদশীতে সানন্দে অন্ততঃ ফলাহার করিবে।


এছাড়াও পদ্মপুরাণেও মাতা একাদশী শ্রীহরির নিকট প্রার্থনা করেছেন, কেউ যদি অনুকল্প প্রসাদ পেয়েও একাদশীর উপবাস করে তবে শ্রীহরি যেন তাকে বিত্ত, ধর্ম ও মোক্ষ দান করেন।

রেফারেন্স:


মামুপোষ্যন্তি যে ভক্ত্যা তব ভক্ত্যা জনার্দ্দন।

সর্ব্বসিদ্ধির্ভবেত্তেষাং যদি তুষ্টোহসি মে প্রভো।।

উপবাসঞ্চ নক্তঞ্চ একভক্তং করোতি চ।

 তন্য বিত্তঞ্চ ধৰ্ম্মঞ্চ মোক্ষং বৈ দেহি মাধব।

[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, ৩৮।১০০-১০১, একাদশীদেবী উক্তি ]

অনুবাদঃ

দেবী একাদশী শ্রীহরিকে বললেন, ' হে জনার্দ্দন! আপনি যদি আমার প্রতি তুষ্ট হইয়া থাকেন তবে আপনার প্রতি ভক্তি করিয়া যাহারা আমার এই একাদশীর দিনে উপবাস করিবে তাহাদের যেন সর্ব্বসিদ্ধি হয়। যে ব্যক্তি (নির্জলা) উপবাস, নক্তাশন বা একাহার করিবে, হে মাধব! তাহাকে আপনি বিত্ত,ধর্ম্ম ও মোক্ষ দান করিবেন।


অতএব একাদশী নির্জলা, সজলা ও সফলা যেকোন ভাবেই থাকা সম্ভব। ব্রতী তার সামর্থ অনুসারে নির্ণয় করবেন তিনি কি রূপে ব্রত পালন করবেন। তিনি চাইলে নির্জলাও করতে পারেন, আবার চাইলে ভগবানকে নিবেদিত রবিশস্য বিহীন অনুকল্প প্রসাদও পেতে পারেন। 


–------------------------------------------

প্রশ্ন: একাদশীতে সবজি খাওয়ার বিধান শাস্ত্রে কোথায় আছে?

–-----------------------------------------

উত্তরঃ

প্রথমে বুঝতে হবে সবজি বলতে কি বুঝায়। আমরা সাধারণত সবজি হিসেবে যা খাই ( যেমনঃ লাউ, পটল, ঝিঙ্গা, ঢেড়স ইত্যাদি) এগুলো আসলে ফল। পুষ্প নিষেকের মাধ্যমে উদ্ভিদের ফল হয়। যে সকল ফলের সেলুলোজ আমরা সরাসরি হজম করতে পারি না, তাদেরকে আমরা রান্ন করে খাই, তাই এ জাতীয় ফলকে আমরা সবজি হিসেবে চিনি। এছাড়া বিভিন্ন রকম কন্দ ( যেমনঃ বাদাম, আলু, মিষ্টি আলু, গাজর, মূলা, কচু ইত্যাদি) -ও আমরা রান্না করে খাই, তাই এদেরও সবজি বলে। অর্থাৎ, উদ্ভিদের ফুল, ফল, পত্র, কন্দ যা আমরা রান্না করে খাই, তা সবজি হিসেবে পরিচিত।  


বৈদিক শাস্ত্রে আমাদের (রবিশস্য ভিন্ন) ফল, মূল, কন্দ সবই একাদশীর দিন গ্রগণের অনুমোদন দিয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক-


ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ:

উপবাসাসমৰ্থশ্চ ফলমূলজলং পিবেৎ।

[ শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখন্ড, ২৭। ১২ ]

বঙ্গানুবাদঃ

(নির্জলা) উপবাসে অসমর্থ হলে ফল, মূল(কন্দ), জল গ্রহণ করতে পারবে।


গর্গসংহিতা: 

অন্নান্ সর্ব্বান বৰ্জ্জয়িত্বা গৌধূমাদ্যাম্নৃপেশ্বর। 

একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহার মুদা নরঃ ॥ ৫০ 

অন্নং ভুঞ্জতি যো রাজন্নেকাদশ্যাং নরাধমঃ।

 ইহ লোকে স চান্ডালো মৃতঃ প্রাপ্নোতি দুর্গতিম্ 

দধি দুগ্ধং তথা মিষ্টং কূটং কর্কটিকাং তথা। 

বাস্তূকং পদ্মমূলঞ্চ রসালং জানকীফলম্ ॥ ৫২ 

গঙ্গাফলং পত্রনিম্বুং দাড়িম্বঞ্চ বিশেষতঃ । 

শৃঙ্গাটকং নাগরঙ্গং সৈন্ধবং কদলীফলম্ ॥ ৫৩ 

আম্রাতকং চার্দ্রকঞ্চ তুলঞ্চ বদরীফলম্ । 

জম্বুফল্মামলকং পটোলং ত্রিকুশ তথা ॥ ৫৪

রতালুং শর্করাকন্দমিক্ষুদণ্ডঃ তথৈব চ। 

দ্রাক্ষাদীনি হি চন্যানি পবিত্রঞ্চ ফলং তথা ॥৫৫ 

একবারঞ্চ রাজেন্দ্র ভোক্তব্যং হরিবাসরে। 

তৃতীয়ে প্রহরেঽতীতে প্রস্থস্য চ পলস্য চ। ৫৬ 

[ গর্গসংহিতা, অধ্যায় ৬১, শ্লোক- ৫০-৫৬ ]

বঙ্গানুবাদঃ

হে নৃপবর! গম, আটা, ময়দা ইত্যাদি সর্ববিধ অন্ন বর্জন করিয়া মানব একাদশীতে সানন্দে অন্ততঃ ফলাহার করিবে। হে রাজন! যে নরাধম একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, সে ইহলোকে চণ্ডালতুল্য ও পরলোকে দুর্গতি ভাজন হয়। হে রাজন! একাদশীতে দধি, দুগ্ধ, মিষ্ট, কূট ও কর্কটিকা এবং বাস্তূক, পদ্ম- মূল, আম, জানকীফল, গঙ্গাফল, পত্রনিম্বু, দাড়িম, শৃঙ্গাটক, নাগরঙ্গ, সৈদ্ধব, কদলী,আম্রাতক, আর্দ্রক, তুল, বদরী, জম্বু, আমলক, পটোল, ত্রিকুশ, রতালু- আলু, শর্করাকন্দ- মিষ্টি আলু, ইক্ষুদন্ড এবং দ্রাক্ষাদি অন্যান্য পবিত্র ফল মূল একবার ভক্ষণ করিবে। আবার বেলা তৃতীয় প্রহর অতীত হইলে প্রস্থ বা পলাদি পরিমিত দ্রব্যের দ্বিজকে দিয়া অর্দ্ধ নিজে ভোজন করিতে পারিবে। 


–------------------------------------------

প্রশ্ন: একাদশীতে রবিশস্য বর্জন করার কথা কোন শাস্ত্রে আছে?

–-----------------------------------------

উত্তরঃ 

শুধু একাদশীই নয়, সমস্ত প্রকার উপবাসে রবিশস্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। একাদশীতে পাঁচ ধরনের শস্য জাতীয় খাওয়ার নিষিদ্ধ। শস্য কাকে বলে? বৈদিক শাস্ত্রে শস্য হল যাদের ফল(ফলের শাঁসালো অংশ endocarp) ও বীজ কে আলাদা করা যায়না। যেমন সমস্ত ধরনের চাল, ডাল, ভুট্টা, গম, সরিষা এগুলি হল শস্য। 


অন্নান্ সর্ব্বান বৰ্জ্জয়িত্বা গৌধূমাদ্যাম্নৃপেশ্বর। 

একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহার মুদা নরঃ ॥ 

[ গর্গসংহিতা, অধ্যায় ৬১, শ্লোক- ৫০ ]

বঙ্গানুবাদ:

হে নৃপবর! গোধূমাদি( গম,আটা, ময়দা এবং অনুরূপ) সর্ববিধ অন্ন(রবিশস্য) বর্জন করিয়া মানব একাদশীতে সানন্দে অন্ততঃ ফলাহার করিবে।


–-----------------------------------

প্রশ্ন: ব্রত রেখে কি ওষুধ খাওয়া যায়?

–-----------------------------------

উত্তরঃ 

মহাভারতের উদ্যোগপর্বে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ওষুধ গ্রহণে উপবাস ভঙ্গ হয় না।


অষ্টৈতান্যব্ৰতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ। 

হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম।

[ মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৩৯।৭০ ]

বঙ্গানুবাদ:

ফল, মূল, ক্ষীর, ঘৃত, ব্রাহ্মণ কামনা, গুরুর বচন ও ঔষধ এই আটটি ব্রত-নাশক নহে।



উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা জানলাম, একাদশীতে নির্জলা উপবাস রাখতে অসমর্থবান ব্যক্তি চাইলে অনুকল্প প্রসাদ পেয়ে একাদশী ব্রত করতে পারেন। একাদশীর দিন সামর্থ অনুসারে ব্রত করে বেশি বেশি কৃষ্ণভাবনাময় থাকার মাধ্যমে আমরা নিজেদের জীবনকে ধন্য করতে পারি। বেদে তাই বলা হচ্ছে, যিনি ভগবানের প্রীতার্থে উপবাস ব্রত করেন, তিনি নিশ্চয় জ্ঞানী। 


তমেতং বেদান বচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসাংনাশকেনৈতমেব বিদিত্বা মুনির্ভবতি।

[বৃহদারণ্যক ঊপনিষদ ৪/৪/২২]

বঙ্গানুবাদঃ

বেদবচন, যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও উপবাস ব্রত দ্বারা ব্রহ্মবিদগণ পরমেশ্বরকে জানিতে চাহেন। ইহাকে জানিয়াই মানুষ মুনি হয়।


হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

@Gaudiya Scripture