প্রশ্ন:- শ্রীধর স্বামী কি অদ্বৈতবাদী ছিলেন?
সিদ্ধান্ত:- শ্রীধরস্বামী কে অনেকেই অদ্বৈতবাদী মনে করেন, পুরীর গোবর্দ্ধন মঠের গুরু পরম্পরায় ১০ম, ৫১তম, ৬৮ তম, ও ১১৬ তম গুরুর নাম শ্রীধরস্বামী হওয়ায় ভাগবত এর টীকাকার শ্রীধরস্বামী কে অদ্বৈতবাদী ও পুরীর শঙ্করাচার্য্য পীঠাসীন বলে অনেকে মনে করেন। এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যেহেতু শ্রীধরস্বামীকেই মানতে বলেছেন তাই অনেকে সিদ্ধান্ত দেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অদ্বৈতবাদী সিদ্ধান্ত কেই মানতে বলেছেন। কিন্তু গীতা ভাগবতের টীকাকার শ্রীধর স্বামী ও পুরী গোবর্দ্ধন মঠের পীঠাধীশ শ্রীধরস্বামী একব্যাক্তি ছিলেন না। গীতা ভাগবতের টীকাকার শ্রীধরস্বামী বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ী রুদ্র বৈষ্ণব পরম্পরার ছিলেন।
জগন্নাথ দাসের ওড়িয়া ভাগবত ও শ্যামানান্দ প্রকাশ গ্রন্থ থেকে জানা যায় শ্রীধর স্বামীর সময়কাল ১৩০০-১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। অথচ পুরী গোবর্দ্ধন মঠের পরম্পরাতে ১০ম, ৫১তম, ৬৮ তম, ও ১১৬ তম শঙ্করাচার্য্যের নাম শ্রীধর স্বামী। তাদের সময় কাল যথাক্রমে
গোবর্দ্ধন মঠ প্রতিষ্ঠা ৪৮৬ খৃঃ পূঃ আদি শঙ্কর
প্রথম পীঠাধীশ ৪৮৩-৪৫৯ খৃঃ পূঃ শ্রীপদ্মপাদাচার্য্য
১০ম পীঠাধীশ ৩২৮-৩১০ খৃঃ পূঃ শ্রীধর স্বামী
৫১তম পীঠাধীশ ৩৬৮-৩৮৭ খৃষ্টাব্দ শ্রীধর স্বামী
৬৮ তম পীঠাধীশ ৬৫০-৬৬৯ খৃষ্টাব্দ শ্রীধর স্বামী
১১৬ তম পীঠাধীশ ১৪৬০-১৪৭১ খৃষ্টাব্দ শ্রীধর স্বামী
তাই শ্রীমদ্ভাগবত, ও গীতার টীকাকার শ্রীধরস্বামী পুরীর শঙ্করাচার্য্য ছিলেন না। [1]
শ্রীধরস্বামীর গুরু পরম্পরা
গীতা ও ভাগবতের টীকাকার শ্রীধরস্বামীর গুরুদেবের নাম পরমানন্দ। ভাগবত টীকাকার শ্রীধরস্বামী তার গুরুদেবের নাম তার গ্রন্থের বহুস্থানে তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পুরীতে শ্রীধর স্বামী নামে যারা শঙ্করাচার্য্য ছিলেন তাদের গুরুর নাম যথাক্রমে গোবিন্দ স্বামী, বোধায়ন স্বামী, জগন্নাথ স্বামী, সুতপানন্দ স্বামী।
বিষ্ণুপুরাণ টীকায়
শ্রীবিন্দুমাধবং বন্দে পরমানন্দবিগ্রহম্।
বাচং বিশ্বেশ্বরং গঙ্গাং পরাশরমুখান্ মুনীন্।।
শ্রীগুরুং পরমানন্দং বন্দে আনন্দবিগ্ৰহম্ ।
যস্য সন্নতিমাত্রেণ চিদানন্দায়তে বপুঃ ৷।
ভাবার্থদীপিকা critical edition by puridas goswami Page 1519 EPN 597
তিনি ভাগবত দ্বাদশ স্কন্দ ভাবার্থদীপিকা সমাপ্ত করেছেন এই বলে—
ভাবার্থদীপিকামেতাং ভগবদ্ভক্ত বৎসলাম্।
পরমানন্দপাদাব্জভৃঙ্গশ্রীঃ শ্রীধরোঽকরোৎ।।
স্ববালচপলালাপৈঃ স্বলীলাপরিনর্ত্তিতৈঃ।
প্রীয়তাং পরমানন্দ নৃহরি সদগুরুঃ স্বয়ম্।।
ভাবার্থদীপিকা critical edition by puridas goswami Page no EPN 655
ভক্তমাল গ্রন্থেও শ্রীধরস্বামীর গুরুর নাম বলা হয়েছে পরমানন্দ।
পুরী গোবর্দ্ধন মঠের মঠাম্নায়ে ১১৬ তম পীঠাধীশ শ্রীধরস্বামীর নাম আছে যার গুরুদেবের নাম সুতপানন্দ স্বামী ও পরমগুরুদেবের নাম বোধানন্দ সরস্বতী স্বামী। ওড়িশার কপিলাশের শঙ্করানন্দ ভোগবর্দ্ধন মঠের গুরুক্রমাম্নায় এ শ্রীধরস্বামীর নাম আছে। এই মঠের গুরুক্রমাম্নায় এর সংস্কৃত স্তোত্রটি থেকে সন্দেহ হয় যে ইনিই ভাগবত টীকাকার শ্রীধরস্বামী। কিন্তু এই স্তোত্রটি মঠের গুরুপরম্পরা দেখে পরবর্তী কালে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র তর্ক সাংখ্য ন্যায়তীর্থ। (যার সময়কাল চৈতন্যমহাপ্রভুর ও পরে) তাই তিনি রামকৃষ্ণানন্দ এর শিষ্য শ্রীধরস্বামীকে ভাগবত টীকাকার শ্রীধরস্বামী বলে ভুল করেছেন। তাতেই একটা বড় গন্ডগোল হয়ে গেছে।
শ্রীধরস্বামী বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
শ্রীধরস্বামী যে বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় ভুক্ত ছিলেন তা বর্তমান শুদ্ধাদ্বৈতমতানুসারী রুদ্র বিষ্ণুস্বামী পরম্পরানুগত বল্লভ সম্প্রদায়ের গ্রন্থে পাওয়া যায়। এবং শ্রীধরস্বামী ও তার গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানে রুদ্র বৈষ্ণব পরম্পরার বিষ্ণুস্বামী নামক আচার্য্যের মত উল্লেখ করেছেন।
১)বল্লভ দিগ্বিজয় গ্রন্থে বিষ্ণুস্বামীর এক শিষ্য পরমানন্দের উল্লেখ আছে। যদিও বিষ্ণুস্বামীর সময়কাল শ্রীধরস্বামীর সময়কাল এ পার্থক্য অনেক। তাই এই পরমানন্দ শ্রীধরস্বামীর গুরু হওয়া সম্ভব নয়। আবার এটিও সম্ভব যে বল্লভ দিগ্বিজয় রচয়িতার কাছে বিষ্ণুস্বামী থেকে পরমানন্দ পর্যন্ত পরম্পরা অজ্ঞাত ছিল। তাই বিষ্ণুস্বামীর পরেই পরমানন্দের নাম উল্লেখ করেছেন।
২) ভাগবতের টীকাকার শ্রীধরস্বামী বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় ভুক্ত ছিলেন, কারন তার রচিত গ্রন্থাবলীতে বিষ্ণুস্বামী রচিত সর্বজ্ঞ সুক্ত ইত্যাদি থেকে সিদ্ধান্ত উদ্ধার করেছেন। যেমন বিষ্ণুপুরাণ টীকা ১/১২/৭০ এ “তদুক্তং সর্বজ্ঞসূক্তৌ"
ভাবার্থ দীপিকায় ১/৭/৬ এ বিষ্ণুস্বামীর মত দ্বারা সংক্ষেপে ভাগবতের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। “তদুক্তং বিষ্ণুস্বামিনা হ্লাদিন্যা সংবিদাশ্লিষ্টঃ সচ্চিদানন্দ ঈশ্বরঃ। স্বাবিদ্যাসংবৃতো জীবঃ সংক্লেশনিকরাকরঃ।। স ঈশো যদ্বশো মায়া স জীবো যস্তয়ার্দিতঃ। স্বাবির্ভূতপরানন্দঃ স্বাবি্রভূতসুদুঃখভূঃ। স্বাদৃগুত্থবিপর্যাসভবভেদজভীশুচঃ। যন্মায়য়া জুষন্নাস্তে তমিমং নৃহরিং নুমঃ।।
এছাড়া ও ভাবার্থ দীপিকায় ৩/১২/১-২ ও ১০/৮৭/২১ বিষ্ণুস্বামীর মত ব্যাখ্যা করেছেন।
৩) তিনি ভাগবতের টীকার প্রথমেই অদ্বৈতবাদী দের একমাত্র পরমপুরুষার্থ মোক্ষ কে কৈতব বা কপটতা বলে নিন্দা করেছেন।
৪) শ্রীজীব গোস্বামী ও তত্ত্ব সন্দর্ভে তাকে পরমবৈষ্ণব বলেছেন “পরমবৈষ্ণবানাং শ্রীধরস্বামিচরণানাং শুদ্ধবৈষ্ণব সিদ্ধান্তানুগতা" তত্ত্বসন্দর্ভ অনুচ্ছেদ ২৭
৫) অনেকে এই যুক্তি দেখান যে শ্রীধর স্বামী গীতা সুবোধিনী টীকা মঙ্গলাচরনে বলেছেন তিনি আচার্য্য শঙ্করের টীকা অনুসরনে ব্যাখ্যা করেছেন।
ভাষ্যকারমতং সম্যক তদ্ব্যাখ্যাতুর্গিরস্তথা।
যথামতি সমালোক্য গীতাব্যাখ্যাং সমারভে।।
আমি ভাষ্যকার ও তার ব্যাখ্যাকারীর মত অবগত হয়ে গীতাশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করলাম।
তিনি এখানে ভাষ্যকার বলতে শঙ্করাচার্য্য কেই যে বুঝিয়েছেন তা কিকরে বলা যায়। গীতাপ্রেস এর অনুবাদে “ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য্যের মতকে" বলাতে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মূল শ্লোকে শঙ্করাচার্য্য শব্দটি নেই।
সম্ভবত শ্রীধরস্বামীর কাছে প্রাচীন বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের গীতাভাষ্য ইত্যাদি কিছু গ্রন্থ উপলব্ধ ছিল, যেখান থেকে তিনি বিষ্ণুস্বামীর মত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
প্রাচীন বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের প্রধান উপাস্য নৃসিংহদেব তাদের প্রধান শ্রুতি নৃসিংহতাপনী উপনিষদ, এবং একটি প্রাচীন স্মৃতি গ্রন্থ আছে নৃসিংহ পরিচর্য্যা (এর রচনা হরিভক্তিবিলাসের ও আগে। কৃষ্ণদেবাচার্য্য এই গ্রন্থ টি রচনা করেন।)
শ্রীধরস্বামী ও ভাগবতের টীকার প্রারম্ভে নৃসিংহদেবের বন্দনা করেছেন।
বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় রুদ্র বৈষ্ণব সম্প্রদায় তাই ভাগবতের টীকার প্রারম্ভে শ্রীধরস্বামী নিজ সম্প্রদায় প্রবর্তক আদিগুরু শিব এর বন্দনা করেছেন।
এই সম্প্রদায়ের আরেক আচার্য্য লক্ষ্মীধর স্বামী ভগবন্নামকৌমুদী গ্রন্থ রচনা করেন। বিল্বমঙ্গল ঠাকুর বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ী প্রাচীন বৈষ্ণব ছিলেন যার রচিত কৃষ্ণকর্ণামৃত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং আস্বাদন করতেন। বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের আরেকজন প্রাচীন আচার্য্য ছিলেন কেশবাচার্য্য। তিনি বৃন্দাবনে হারিজু কুন্ড থেকে হরিদেব বিগ্রহ কে উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি গোবর্দ্ধন শতক কাব্যে হরিদেবজী ও তার অভিন্ন স্বরূপ গোবর্দ্ধনের বন্দনা করেছেন।
প্রশ্ন:- শ্রীবল্লভাচার্য্য শ্রীধরস্বামীর ভাগবত ব্যাখ্যাকে দোষদুষ্ট কেন বলেছেন যদি শ্রীধরস্বামী তার পূর্বাচার্য্য ই হবেন?
উত্তর:- শ্রীবল্লভাচার্য্য যদিও নিজেকে বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের বলেছেন কিন্তু বিষ্ণুস্বামীর মতকেও তিনি দোষদুষ্ট বলেছেন। সুবোধিনী ৩/৩২/৩৭
সম্ভবত নিজের প্রতিষ্ঠিত পুষ্টিমার্গীয় সম্প্রদায়ের অভিনবত্ব প্রদর্শনের জন্যই তার এই চেষ্টা।
প্রশ্ন:- শ্রীধরস্বামী এর শ্রীমদ্ভাগবত টীকা অনেকক্ষেত্রে অদ্বৈতপর।
উত্তর:- বিষ্ণুস্বামী শুদ্ধাদ্বৈত মতাবলম্বী। শঙ্করের অদ্বৈতবাদ কে তারা কেবলাদ্বৈত বাদ বলেন। শঙ্করের অদ্বৈতবাদে ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা দ্বৈততা প্রাপ্ত হয়েছে, আর শুদ্ধ অদ্বৈতবাদ এ বলা হয় ব্রহ্ম স্ব ইচ্ছায় ক্রীড়ার জন্য দ্বৈততা প্রাপ্ত হয়েছেন। এই দুই দর্শনেই ব্রহ্মই জগৎ এরকম বলা হয় তবে পার্থক্য এইযে অদ্বৈতবাদীগণ বলেন মায়ার কারনে ব্রহ্মকেই জগৎ বলে ভ্রম হয় আর শুদ্ধাদ্বৈতবাদীগণ বলেন ব্রহ্মের লীলাবশত ব্রহ্মের সদংশ কে জগৎ, চিদংশ কে জীব বলে প্রতীতি হয়। আর তাই শুদ্ধাদ্বৈত দর্শন না জানার কারনে অনেকেই শ্রীধরস্বামীর ভাষ্য পড়ে অদ্বৈতবাদ বলে ভুল করেন।
প্রশ্ন:- শ্রীধরস্বামী যদি অদ্বৈতবাদী না হবেন তিনি বিষ্ণুপুরাণের টীকায় কেন বলেছেন “দ্বৈতবাদীনোঽপরমার্থবাদী" দ্বৈতবাদীরা অপরমার্থবাদী?
উত্তর:- শ্রীধরস্বামী বিষ্ণুস্বামী মতানুসারী শুদ্ধাদ্বৈতবাদী বৈষ্ণবাচার্য্য শঙ্করমতানুসারী কেবলাদ্বৈতবাদী নন। তাই তিনি সাংখ্যমতানুসারী দের অপরমার্থবাদী বলেছেন যারা প্রকৃতি ও ঈশ্বর এই দুই জগৎকারন মানেন। এখানে দ্বৈতবাদী বলতে মধ্বাচার্য্যের সম্প্রদায় বা বৈষ্ণব সম্প্রদায় কে বোঝানো হয়নি।
Bibliography
1) Orissa historical research journal vol XIII April 1965 no 1 A short note on śridhara svāmin by Padma Shri P. Acharya
1) পুরী গোবর্ধন মঠের গুরু পরম্পরা (১১৬ তম গুরু শ্রীধর স্বামীর গুরুদেবের নাম শ্রী সুতপানন্দ স্বামী)
Shastri Krishnashankar, vol 12 page 343
গীতা সুবোধিনী শ্রীধরস্বামী কৃত মঙ্গলাচরণ গীতাপ্রেস সং