অম্ভৃণ সূক্ত
এই সূক্ত টি ঋকবেদ ১০ম মন্ডলে ১২৫সূক্ত ও অথর্ববেদ চতুর্থকান্ডে ৩০ সূক্তে আছে। সায়ণাচার্য্যের মতে অম্ভৃণ নামক ঋষির কন্যা বিদূষী বাক এই সূক্তের দ্রষ্টা। তাই একে অম্ভৃণ সূক্ত বা পরমাত্মা সূক্ত ও বলা হয়।
।। ১ম মন্ত্র ।।
অহং রুদ্রেভির্ব্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যেরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভৰ্ম্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোনভা।। ১
অনুবাদ:- আমি রুদ্রগণ ও বসুগণ কে ধারণ করি, আমি আদিত্যদিগের সঙ্গে এবং তাবৎ দেবতাগণকে ধারণ করি, আমি মিত্র ও বরুণ এই উভয়কে ধারণ করি, আমিই ইন্দ্র ও অগ্নি এবং দুই অশ্বিদ্বয়কে ধারণ করি।
গৌড়ীয় ভাষ্য
আমি রুদ্র ও বসুগণ কে ধারণ করি। রুদ্র অর্থাৎ একাদশ রুদ্র। এই একাদশ রুদ্র গণ কারা? ভাগবতে বলা হয়েছে
“রৈবতোজো ভবো ভীমো বাম উগ্রো বৃষাকপিঃ। অজৈকপাদহির্বুধ্নির্বামদেবো মহানিতি"
মহান শব্দে প্রধান রুদ্র মহাদেব কে বোঝানো হয়েছে।
বসু অর্থাৎ অষ্টাদশ বসু গণের কথা বলা হয়েছে যথা ভাগবতে—
দ্রোণঃ প্রাণৈ ধ্রুবোঽর্কোঽগ্নির্দোষো বস্তুর্বিভাবসুঃ।
দ্বাদশ আদিত্য যথা ভাগবতে—
বিবস্বানর্যমা পুষা ত্বষ্টা চ সবিতা ভগঃ।
ধাতা বিধাতা বরূণো মিত্রঃ শক্র উরুক্রমঃ।।
বিশ্বদেবা শব্দে বোঝানো হয়েছে
কামকালৌ ক্রতুদক্ষৌ সবসত্যৌ ধুরিলোচনৌ পুরুরবার্দ্রবৌ চেতি নান্দীদেবতাঃ।
চরামি শব্দে এই সকলের নিয়ন্তা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আমিই এদের সকলকে সৃষ্টি করি , নিয়ন্ত্রণ করি এবং অন্তঃকালে তাদের সংহার করি।
আমি দশদিকপালগণকেও ধারণ করে আছি তা বোঝাতে পুনরায় বলছেন
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভৰ্ম্মীতি। মিত্রা পূর্ব দিগাভিমাণী দেবতা, বরুণ পশ্চিম দিগাভিমাণী দেবতা, এই সকল দিক এর অধিপতিগণের শক্তির উৎস ও আমি। আমিই তাদের ধারণ করে আছি। এই রূপ লোকপাল গণ যথা ইন্দ্র ও অশ্বিনী কুমার দ্বয় কেও আমিই ধারণ করে আছি। তাদের শক্তির উৎস ও আমি।
ঋকবেদে ঋষিগণ প্রশ্ন করেছেন কোথা থেকে এই সমস্ত সৃষ্টি হলো? কে এই দেবতা দের সৃষ্টি করলো?
কঃ অদ্ধা বেদ কঃ ইহ প্র বোচৎ কুতঃ আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ
অর্ব্বাক দেবাঃ অস্য বিসর্জ্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব (ঋকবেদ ১০/১২৯/৬)
সায়ন ভাষ্য অনুযায়ী অনুবাদ:- কেই বা প্রকৃত জানে কেই বা বর্ননা করবে কোথা হতে জন্ম হল, কোথা হতে এই সকল সৃষ্টি হল, দেবতারা এই সমস্ত সৃষ্টির পর হয়েছেন। কোথা হইতে যে হল তা কেই বা জানেন।
তার উত্তরে এই সূক্তে বলা হচ্ছে কার থেকে এই দেবতাগণ উৎপন্ন হন। কার দ্বারা এই দেবতাগণ নিয়ন্ত্রিত হন। এবং প্রলয়ে কার মধ্যে সকল দেবতাগণ লয় প্রাপ্ত হন। ঋষিকা বাক বলেছেন আমিই এই দেবতাগণ কে ধারণ করি, আমার দ্বারাই তারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
এই সূক্তেরভাষ্যে সায়ণাচার্য্য বলেছেন রুদ্রৈঃ তদাত্মনা চরামি, এবং বসুভিরিত্যাদৌ তত্তদাত্মনা চরামীতি যোজ্যং। অর্থাৎ অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করে তিনি যে নিজে ই ব্রহ্ম তা অনুভব করে বলছেন আমিই রুদ্র ও বসুজ্ঞান কে ধারণ করে আছি, ইত্যাদি। কিন্তু এই রূপ অর্থ করলে প্রথম ও দ্বিতীয় পাদের মধ্যে বিরোধ হয়ে যায়। কারন বিভর্মি অর্থাৎ ধারয়ামি। ধারণ ক্রিয়া তখন ই সম্ভব যখন দুটি বস্তুর অস্তিত্ব থাকে। অদ্বৈত হলে কে কাকে ধারণ করবে?
সায়ণাচার্য্য তার উত্তরে বলছেন না অহং সর্বং ধারয়ামীতি ময়ি সর্বং জগৎ শুক্তৌ রজতমিবাধ্যস্তং সদ্দৃশ্যতে মায়া চ জগদাকারেণ বিবর্ত্ততে। তাদৃশ্যা মায়য়া আধারত্বেন অসঙ্গস্যাপি ব্রহ্মণ উক্তস্য সর্ব্বস্যো্ৎপত্তিঃ।।
আমি সকল কিছু কে ধারণ করি কিরকম ভাবে শুক্তিতে যেমন রজতের অধ্যাস হয় সেইভাবে মায়ার দ্বারা ব্রহ্ম জগৎ আকারে বিবর্ত্তিত হয়। সেই জগতকে আমি ধারণ করি। (ঝিনুক দেখে কারোর মনে হতে পারে এটি রূপো, যখন জ্ঞান হয় এটি ঝিনুক তখন রূপো এই ভ্রম দূর হয়ে যায় কেবল ঝিনুক ই থাকে। এক বস্তুতে অন্য বস্তুর এই প্রতীতি কে অধ্যাস বলে। তেমন মায়ার কারনে ব্রহ্ম কেই জগৎ বলে ভ্রম হয়। সেই ভ্রম রূপ জগৎ কে আমি ধারণ করে আছি।)
কিন্তু এই রূপ সিদ্ধান্ত করা হলে ব্রহ্ম পরিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ ব্রহ্ম এক অংশে জগৎ রূপে বিবর্ত্তিত হল আরেক অংশে সেই ভ্রম রূপ জগৎ কেই ব্রহ্ম ধারণ করে রইল। কিন্তু ব্রহ্মে এরূপ পরিচ্ছিন্নতা সম্ভব নয়। কারন আত্মা ই যখন অচ্ছেদ্য নৈনং চ্ছিদ্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহ্যতি পাবকাঃ তাহলে কিভাবে ব্রহ্ম এর দুই ভাগ কল্পনা করা যায়।
তাহলে বাক নামক ঋষিকা আমিই রুদ্র ও বসু গণকে ধারণ করে আছি এইরূপ বলার তাৎপর্য্য কি?
এই বিষয়ে ব্রহ্মসূত্র বলেন শাস্ত্রদৃষ্ট্যা তূপদেশো বামদেববৎ (১.১.৩১) এই সূত্র ভাষ্যে ভাষ্যকার রামানুজ বলেছেন—
জীব কখনো ব্রহ্ম হতে পারেনা। জীব যে আমাকেই জানবে, আমাকেই উপাসনা করো ইত্যাদি বলে উপাস্য ব্রহ্মের উপদেশ দেন তার কারন তিনি নিজেকে ব্রহ্মের সাথে গুণগত ভাবে অভিন্ন এই দেহ থেকে পৃথক চিন্ময় আত্মা বলে জেনেছেন। তাই আমি যার শরীর সেই আত্মার ও আত্মা পরমাত্মা ই উপাস্য এইভাবে উপদেশ দিয়েছেন। যেমন বামদেব ঋষি পরমাত্মাকে সকল বস্তুর অন্তরাত্মা রূপে অনুভব করে সমস্ত বস্তুকে তার শরীর রূপে অনুভব করে বলেছিলেন আমি ই মনু হয়েছিলাম, সূর্য্য হয়েছিলাম।
পশ্যন্নৃষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেঽহং মনুরভবং সূর্যশ্চেতি। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)
এখানে বামদেব ঋষি নিজেই পরমাত্মা নন, সকল বস্তুই পরমাত্মার শরীর, আমি ও পরমাত্মার শরীর এই সামানাধিকরণ্য বৃত্তিতে তার সাথে মনু ও সূর্য্যের অভিন্নত্বের উপদেশ দিয়েছেন।
এখন এই মন্ত্রে অহং বলতে কার কথা বলা হয়েছে? যার দ্বারা রুদ্র, বসু, আদিত্য, বিশ্বদেবগণ, ও ইন্দ্রাদি লোকপালগণ, মিত্রাবরুণাদি দিকপালগণ নিয়ন্ত্রিত হন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্ম ই সমস্ত দেবগণ কে নিয়ন্ত্রণ করেন।
“য ইমং চ লোকং পরমং চ লোকং সর্বাণি চ ভূতানি যোঽন্তরো যময়তি" (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৩.৭.১)
অনুবাদ:- পরব্রহ্ম ই এই লোক, পরলোক, তথা সমস্ত প্রাণি গণের ভিতরে অবস্থান করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করি।
তৈত্তীরীয় উপনিষদে ভৃগুবল্লী ১ম মন্ত্রে বলা হয়েছে “যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি, তদ বিজিজ্ঞাসস্ব, তদ ব্রহ্ম।" তৈত্তীরীয়
অনুবাদ:-
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/১১
ব্রহ্ম বা ইদমগ্রে আসীদেকমেহ তদেকং সন্ন ব্যভবৎ.........ইন্দ্র বরুন সোমো রুদ্রঃ পর্যন্যো যমো মৃত্যুঃ ঈশান।
অনুবাদ:- সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র একমাত্র ব্রহ্ম ই ছিল,..... তিনি ইন্দ্র, বরুণ, সোম, রুদ্র, পর্যন্য, যম, মৃত্যু, ঈশান আদি দেবগণ কে সৃষ্টি করলেন।
অর্থাৎ এই সমস্ত দেবতারা
কঠোপনিষদে বলা হয়েছে সেই পরব্রহ্ম বিষ্ণুই জীবের পরম গতি—
সোহধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। (কঠোপনিষদ১.৩.৯)
অনুবাদ:- তিনি অবশ্যই জীবের পরম গতি ভগবান বিষ্ণুকে লাভ করতে সক্ষম হন।
অগ্নি আদিত্য গণ সহ সমস্ত দেবগণ যে বিষ্ণু থেকেই জাত তা ঋকবেদ এ ও বলা হয়েছে।
ন তে বিষ্ণো জায়মানো ন জাতো দেব মহিম্নঃ পরমন্তমাপ।
উরুং যজ্ঞায় চক্রথুরু লোকং জনয়ন্তা সূর্যমুষাসমগ্নিম।। ৭/৯৯/২
অনুবাদ:-হে বিষ্ণু যজ্ঞের জন্য আপনি এই বিস্তীর্ণ পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন। আপনি সূর্যকে উষাকে অগ্নিকে জন্ম দিয়েছেন।
তাই সকল দেবগণ বিষ্ণুর থেকেই উৎপন্ন, বিষ্ণুর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, ও অন্তিমে বিষ্ণুতেই লয় প্রাপ্ত হয়। তাই এই সূক্তে অহং বলতে বিষ্ণুকেই বোঝানো হয়েছে।
ভগবান বিষ্ণুই যে অগ্নি, ইন্দ্র, সূর্য্য আদি সমস্ত দেবতা দের শক্তির উৎস, ভগবান বিষ্ণুর দ্বারাই যে তারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা ঋকবেদ এ বলা হয়েছে।
বিষ্ণোর্নু কং প্রা বোচং বীর্যাণি যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্রমাণস্ত্রেধোরুগায়ঃ। ৪
অনুবাদ- বিষ্ণু র বীরকর্মের কথা বলছি যিনি পৃথিব্যাদি লোকসকল অথবা পার্থিব অগ্নি বিদ্যুৎ ও সূর্যরূপ জ্যোতি নির্মান করেছেন। যিনি পৃথিবী অন্তরীক্ষ ও দ্যুলোকে পাদবিক্ষেপ করে স্বর্গলোককে ধারণ করেছেন।
(অথর্ববেদ ৭ম কান্ড ৩য় অনুবাক ১ম সূক্ত ৪ মন্ত্র)
বিষ্ণু র শক্তিতেই ইন্দ্র সকল লোকে বরণীয়। যথা ঋকবেদে—
তমস্য বিষ্ণুর্মহিমানমোজসাংশুং দধন্বান মধুনো বি রূপশতে।
দেবেভিরিন্দ্রো মঘবা সয়াবভির্ব্বৃত্রং জঘন্বাঁ অভবদ্বরেণ্যঃ।। ১০/১১৩/২
অনুবাদ:- বিষ্ণু নিজ তেজ জাত সোমলতাখন্ড প্রেরণ করে ইন্দ্রের শক্তি বর্ধন করে ছিলেন। ইন্দ্র সহযায়ী দেবতাদের সাথে একত্র হয়ে বৃত্রকে নিধনপূর্বক সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন, সকলের বরণীয় ও ভজনীয় হলেন।
তাই এই সূক্তে অহং বলতে সকল দেবতা র স্রষ্টা, ধারক, নিয়ন্ত্রক ও সংহারক ভগবান বিষ্ণুর কথা বলা হয়েছে।